ঢাকার সাভারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় গত ১৯ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছে পঞ্চাশোর্ধ্ব আজিজুর রহমানকে। পুলিশের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তার, ছাত্র-জনতা হত্যায় জড়িত থাকারও প্রমাণ রয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ আমলে দুই দফায় ভুয়া পরোয়ানায় ১০০ দিন ও ২৯ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে আজিজুর রহমানকে। নথি অনুযায়ী, সেগুলোও ছিল ভুয়া মামলা।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় অন্তত চারটি মামলার আসামি আজিজুর রহমান। গত ১৯ জানুয়ারি তাকে সাভারের ফিরিঙ্গিকান্দা এলাকা থেকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
আজিজুর রহমানের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ৫-৬ বছর ধরেই নানাভাবে হয়রানির শিকার পরিবারটি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তার বসতবাড়িতে হামলা করে ৪০-৫০ জনের একটি দল। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও হামলার শিকার হওয়ার কয়েকদিন পর স্থানীয় একটি চক্র অন্য একটি বাড়িতেও হামলা করে দখল করে নেয়। ওই সময় তিনি বুঝতে পারেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে জমিজমা বিরোধের জেরে পূর্বশত্রুতা থাকা একটি গ্রুপ তার বাড়িতে এই হামলা করে। এর কয়েকদিন পর ওই চক্রের মাধ্যমেই জানতে পারেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে তাকে। থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন একই দিনে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাস্থলের চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলার আসামি তিনি।
এসব মামলায় ফের কারাবন্দি থাকতে হতে পারে এমন শঙ্কায় তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, আইজিপি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইন মন্ত্রণালয়ের। এসব দপ্তরে লিখিত আবেদনে তিনি জানান, জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদের জেরে তাকে হয়রানি করছে স্থানীয় একটি চক্র। সেই চক্রের প্ররোচনায় ২০১৮ সালের ৬ মার্চ প্রথম তাকে একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করে সাভার মডেল থানা পুলিশ। সেই মামলায় কারাগারে পাঠানোর পর জামিন পেলেও তিনি মুক্তি পাচ্ছিলেন না। জানতে পারেন, অন্য জেলায়ও পরোয়ানা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন পরোয়ানায় একাধিক জেলায় সব মিলিয়ে ১০০ দিন হাজতবাস করতে হয় তাকে। এ ছাড়া একইভাবে ২০২৩ সালের ২৫ আগস্ট সাভার মডেল থানা পুলিশ তাকে আবারও গ্রেপ্তার করে। এবার তাকে কারাবন্দি থাকতে হয় ২৯ দিন। তবে আগেরবারের অভিজ্ঞতায় পরোয়ানা জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে মুক্তি পান তিনি। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় ৪ মামলায়ও আসামি করা হয় তাকে।
আজিজুর রহমানের দাবি, সাভার মডেল থানায় হওয়া চার মামলার বাদীকে তিনি চেনেন না। বাদীও তাকে চেনেন না। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নন। এজন্য এসব মামলা তদন্ত সাপেক্ষে অব্যাহতির দাবি জানান আজিজুর।
প্রথম দফায় ১০০ দিন হাজত খাটার পর আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১২ জুন মুক্তি পান আজিজুর রহমান। পরে তিনি ওই ঘটনায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন। সেই পিটিশন তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর জেলা ইউনিট। তদন্তে দেখা যায়, জয়দেবপুর থানার মামলাটির বাদী এসআই মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন এর আগে সাভারে কর্মরত ছিলেন। ওই মামলার মাসখানেক আগে তিনি জয়দেবপুরে বদলি হন।
তদন্ত সংস্থা সেই সময় গণমাধ্যমে জানিয়েছিল, মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন আগের কর্মস্থলের কারও মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুক্তভোগীকে ফাঁসিয়ে থাকতে পারেন।
প্রথম দফায় ভুয়া পরোয়ানায় কারাবন্দি থাকার পর আবারও ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট গ্রেপ্তার হন আজিজুর রহমান। এবারের মামলা জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ। গ্রেপ্তারের পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারের ৪ দিন পর ৩০ আগস্ট তার জামিন হয়। ওই জামিননামা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। তবে তিনি জামিনে মুক্ত হতে পারেননি। কারা কর্তৃপক্ষ আজিজুর রহমানকে জানায়, তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ও জামালপুরে আরও দুটি মামলায় পরোয়ানা রয়েছে। আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, আজিজুর রহমানের ছেলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানান, এই পরোয়ানা ভুয়া। তারপরও মুক্তি মেলেনি তার।
এরপর ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম আদালতে আজিজুর রহমানের জামিন আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পরোয়ানা যাচাই করে ভুয়া হিসেবে সাব্যস্ত করে। এ ছাড়া মামলারও সত্যতা না পাওয়ায় তাকে জামিনের আদেশ দেন আদালত।
এসব ঘটনায় আদালতে আরেকটি মামলা করেন আজিজুর রহমান। ওই মামলার তদন্ত করে পিবিআই। এতে দেখা যায়, যে মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে হাজতবাস, সেই মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ না মেলায় অব্যাহতি পান আজিজুর রহমান। পিবিআই তদন্তে প্রতিটি পরোয়ানাই ভুয়া বলে প্রমাণ মেলে।
পরিবারের ভাষ্য: আজিজুর রহমান গত ২০ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে সরেজমিনে সাভারের ফিরিঙ্গিকান্দার বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। টিনের চালার দুই কক্ষের ঘরে স্ত্রী ও ছেলের বউসহ আজিজুরের বসবাস। বাড়িতে দেখা মিলল ভাঙচুরের চিহ্ন। তার স্ত্রী জানালেন, ৪০-৫০ জনের দলটি গাড়িতে করে এসে বাড়িতে হামলা করে। ফ্রিজ, আলমারি, খাটসহ সবকিছু ভাঙচুর করে টাকা, গহনা লুট করে নিয়ে যায়।
মাহিনুর বলেন, ‘আমার স্বামী ২০১৮ সালে ভুয়া মামলায় ১০০ দিন জেল খাটছে, আবার ২০২৩ সালে ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এখন আবার ৪টা মামলা করেছে, গ্রেপ্তার করেছে। আমার স্বামীকে বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। চলার মতো কোনো অবস্থা নেই। সরকারের কাছে এই মামলা থেকে মুক্তি চাই।’
পুলিশের ভাষ্য: আজিজুরকে গ্রেপ্তারকারী সাভারের ভাকুর্তা পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র হত্যায় এজাহারভুক্ত আসামি হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অসুস্থতার কাগজ দেখানো হয়েছে, সেটি এসপি ও ওসি স্যারকে দেখানোর পর তাকে গ্রেপ্তার করি। ভুয়া পরোয়ানায় পূর্বে গ্রেপ্তারের বিষয়ে অবহিত নই।’
তিনি বলেন, ‘সোর্সের খবরের ভিত্তিতে সোর্স নিয়ে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করি। আমার থানার ফোর্স সঙ্গে ছিল।’ তবে সঙ্গে ৪০-৫০ জন নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
মন্তব্য করুন