চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন ছিল বহস্পতিবার। সকালে হাজারো শিক্ষার্থী যখন পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে ছুটছেন, তখন আয়েশা ছুটছেন হাসপাতালে। সেদিনই মা আকস্মিক স্ট্রোক করায় তার জীবন বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে যান আয়েশা। ততক্ষণে পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেছে তার। শত অনুরোধেও কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের মন গলেনি। মেলেনি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি। একদিকে মায়ের অসুস্থতা, অন্যদিকে পরীক্ষা দিতে না পারার কষ্ট—এই দুইয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট আয়েশা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তার সেই কান্না শুধু পরীক্ষা কেন্দ্রের সবাইকে নয়, নাড়া দিয়েছে পুরো দেশকে। আয়েশার এই মানবিক বিপর্যয় সরকারের নজরে এসেছে এবং তার পরীক্ষা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারের সর্বোচ্চ মহল ও শিক্ষা উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে গতকাল শুক্রবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ড আয়েশার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার অনুপস্থিত পরীক্ষার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনাধীন বলে আশ্বস্ত করে তাকে বাকি পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। কথা বলেছে আয়েশার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। তাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর ওই ছাত্রী বাকি পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
গতকাল সকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায়, আয়েশার পুরো ঘটনাটি মানবিক বিবেচনায় তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার জানিয়েছেন, তার বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত আইন ও বিধির আলোকে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আয়েশাকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার অনুরোধ জানান শিক্ষা উপদেষ্টা। এরপর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে সরাসরি আয়েশার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালবেলাকে বলেন, ওই ছাত্রীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাকে বাকি পরীক্ষাগুলোয় অংশগ্রহণ করতে বলেছি। তার আত্মীয়-স্বজনকেও বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। ওই ছাত্রী আমাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাকি পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আয়েশার অনুপস্থিত পরীক্ষার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত আসতে পারে—এমন প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, সব পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তার পরীক্ষাটা কীভাবে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের একটি সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, শিক্ষা বোর্ডের একাধিক প্রশ্নব্যাংক থাকে। বাংলা প্রথম পত্রে যে সেটে পরীক্ষা হয়েছে, সেটি বাদে অন্য যে কোনো একটি সেটে আয়েশার পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। যেহেতু একটি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে, তাকে শিক্ষা বোর্ডে এনে অথবা তার পছন্দমতো জায়গায় পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হতে পারে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, আয়েশার প্রতি শিক্ষা বোর্ড ও সরকারের এই সহানুভূতিশীল মনোভাব তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা অনেকটাই দূর হয়েছে। মানবিক বিবেচনা ও নিয়মের কড়াকড়ির টানাপোড়েনে একটি ইতিবাচক সমাধানের পথ উন্মোচন হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শুরু হওয়ার দিনেই এক করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হয় রাজধানীর মিরপুর। সরকারি বাঙলা কলেজের গেটের বাইরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা যায় পরীক্ষার্থী আয়েশাকে। একদিকে মায়ের স্ট্রোক, অন্যদিকে কেন্দ্রে প্রবেশে দেরি হওয়ায় বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারার বেদনা তাকে এতটাই কাবু করেছিল যে, উপস্থিত অভিভাবক, পথচারী ও অন্য পরীক্ষার্থীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় তার কান্না। তার কান্নার ঢেউ পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
আয়েশার বাবা নেই। তার খালা গণমাধ্যমকে জানান, সকালেই আয়েশার মা স্ট্রোক করেন। পরিবারে অন্য কেউ না থাকায় আয়েশাই তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটে। সেখান থেকে দ্রুত পরীক্ষা দিতে এলেও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেনি।
এ ঘটনা আবারও পরীক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতার স্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। একদিকে নিয়মের কড়াকড়ি, অন্যদিকে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের এমন কঠিন মুহূর্তে মানবিক বিবেচনা—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে আয়েশার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল—এমন প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর কবির দুলু কালবেলাকে বলেন, আয়েশার ঘটনা পুরো পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। সবাই সরকারের ওপরের মহলের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন, এটা প্রমাণ হয়েছে। সরকার নিজ উদ্যোগী হয়ে সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো ওই মেয়েটার জীবন থেকে একটি বছর বা পুরো শিক্ষাজীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে পারত। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ওই মেয়ে যদি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের সন্তান হতো, তখন তারা কী করতেন। তারা আয়েশাকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখেননি। এজন্য কেন্দ্র সচিবসহ যারা পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। তবে সরকার শেষ পর্যন্ত তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে, সেজন্য সাধুবাদ জানান জিয়াউর কবির।
মন্তব্য করুন