বর্ষা মৌসুমে মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। বর্ষায় থেমে থেমে বৃষ্টিপাতে জমে থাকা পানি, অবকাঠামো নির্মাণ, বাড়ির আঙিনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে এখন ডেঙ্গু নিয়মিত রোগে পরিণত হয়েছে। জুন থেকে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মতেও, বৃষ্টির কারণে মশার প্রজনন বাড়ে, ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। চলতি বছরের জুলাই থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
গত ৪৩ দিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবন অবরুদ্ধ ছিল। স্থবির হয়ে পড়ে নাগরিক সেবা। বিঘ্ন ঘটে এডিসের লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রমে। চলতি বছরে মৃত রোগীর অর্ধেকই ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাই এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মশকনিধনে জোর না দিলে জুনের চেয়ে জুলাইয়ে দ্বিগুণের বেশি মানুষ ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। সেইসঙ্গে মৃত্যুও বাড়তে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ তথ্য বলছে, রাজধানীর দুই সিটির ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকি রয়েছে। এসব ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ব্রুটো ইনডেক্সে ২০ শতাংশের বেশি। চলতি বছর এবং গত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মশকনিধনে জোর না দিলে এবার গত বছরের চেয়েও পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও ডেঙ্গুর বাহক নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে পরামর্শ দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে যেন কারও কোনো নজর নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৯ হাজার ২২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে ওই বছরের ২৭ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ হাজার ৫৩৮ জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৪৩ জনের।
মাসের হিসাবে ডেঙ্গু শনাক্ত ও মৃত্যু: চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনের গত ২৭ দিনে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে ৪ হাজার ৮৭৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে সাত, মে মাসে তিন এবং জুনে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৭ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে মাসে ৬৪৪ এবং জুনের ২৭ দিনে শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৮৫ জন। তার মধ্যে জানুয়ারিতে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, মার্চে পাঁচ, এপ্রিলে দুই, মে মাসে ১২ এবং জুনের ২৭ দিনে সাতজনের মৃত্যু হয়।
দেশের সবশেষ অবস্থা: গতকাল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৯ জন। বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত হয়েছেন ১০৭ জন, যা অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। গতকাল মারা যাওয়া দুজনই পুরুষ। তারা দুজনেই বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪০ জন, যাদের মধ্যে ২২ জন পুরুষ ও ১৮ জন নারী। এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ২২২ জন, যার মধ্যে ৫ হাজার ৪২০ জন পুরুষ ও ৩ হাজার ৮০২ জন নারী।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নেই। ২৫ বছরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্লাস্টিক বস্তু, পলিথিনের ব্যাগ, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার এবং নির্মাণ সামগ্রীর বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভার বিস্তার হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সারা দেশের মশকনিধন সম্ভব নয়। ফলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এখনই সচেতনতা গড়ে না উঠলে জুনের চেয়ে অবশ্যই জুলাইয়ে খারাপ অবস্থা হবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। গত বছর ডেন-২-এর বিস্তার ছিল সবচেয়ে বেশি। এবার ডেন-৩ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে।
মন্তব্য করুন