রেজওয়ান রনি, রংপুর
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘হামার কী দোষ, হামার বাড়ি ভাঙিল ক্যান’

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে রংপুরে ১৪ বাড়ি ভাঙচুর
‘হামার কী দোষ, হামার বাড়ি ভাঙিল ক্যান’

রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ী ইউনিয়নের আলদাদপুর গ্রামে স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন হীরন বালা। স্বামী এলাকায় ছোট চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার চালান। মাঝেমধ্যে অভাব-অনটনের সংসারে দিনমজুরের কাজও করেন। রোববার বিকেলে বিক্ষোভকারীরা তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন। এরপর থেকে আহাজারি থামছে না হীরন বালার। তার একটাই প্রশ্ন ‘হামার কী দোষ, হামার বাড়ি ভাঙিল ক্যান।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ওই গ্রামের এক কিশোরকে গত শনিবার সন্ধ্যায় আটক করে পুলিশ। তার পরেও শনিবার সন্ধ্যায় এবং রোববার বিকেলে দুদফায় উপজেলার বেতগাড়ী ইউনিয়নের আলদাদপুর গ্রামে ওই কিশোরের বাড়িসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৪টি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা।

কাঁদতে কাঁদতে হীরনবালা বলেন, ‘এইগলে কী করিল হামার বাড়িঘর। হামার কী দোষ, হামার বাড়ি ভাঙিল ক্যান। হামরা গরিব মানুষ। এখন কী দিয়া বাড়ি ভালো করমো। এখন হামরা কী খামো, কী দিয়ে কী করমো।’

ঘটনার পরদিন গতকাল সোমবার সকালে আলদাদপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হীরনবালার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভ্যানগাড়ি। তাতে তোলা হচ্ছে তোশক, কাপড়-চোপড়, রান্নার হাঁড়িপাতিলসহ ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই পরিবারটি নিজেদের শেষ সম্বল রক্ষার চেষ্টা করছে।

এ সময় কথা হয় হীরনবালার স্বামী অতুল চন্দ্রের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়ি থেকে সব সরিয়ে পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠাচ্ছি। সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। কী হবে কিছুই বুঝতেছি না। খাওয়া-দাওয়াও হয়নি।’

শুধু হীরন বালাই নন, হামলা ও ভাঙচুরের পর আলদাদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার আরও অনেক পরিবার তাদের ঘরের মালপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন নিরাপদে। কথা হয় একই গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী রুহিলা রানী রায়ের সঙ্গে। তারা জানান, রোববার বিকেলে তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। হামলাকারীরা ঘরের লোহার ট্রাঙ্ক ও বাক্স ভেঙে স্বর্ণালংকার, টাকা, জমির কাগজপত্র এবং নতুন কাপড়চোপড় লুট করে নিয়ে যায়।

চোখেমুখে আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব নিয়ে রুহিলা রানী বলেন, ‘আমাদের তো আর কিছু নেই। বাড়িঘর ভেঙে যা ছিল সব নিয়ে গেছে। এখন যা বাঁচাইতে পারছি, তাই সরাইতেছি।’

এ সময় দেখা যায়, শিল্পী রানী নামে এক নারী একটি ভ্যানে করে দুটি ছাগল ও কিছু ঘরোয়া মালপত্র বাবার বাড়িতে পাঠাচ্ছেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কখন কী হয় বলা যায় না। তাই আগেভাগেই মালপত্রগুলো বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার গঙ্গাচড়া এবং পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। এই গ্রামের পার্শ্ববর্তী নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাংলাবাজার হাটে মাইকিং করে ঘোষণা দেওয়া হয়, আলদাদপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী খিলালগঞ্জ বাজারে তারা একটি মানববন্ধন করবেন। আরও বলা হয়, তারা শুধু গঙ্গাচড়া উপজেলা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ মিছিল করবেন, কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা করবেন না। কিন্তু বিকেলের দিকে স্থানীয় খিলালগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয় এবং সেখান থেকে একটি মিছিল আলদাদপুর গ্রামের দিকে আসে। গ্রামে প্রবেশ করে মিছিলটি হঠাৎই সহিংসতায় রূপ নেয়। উত্তেজিত জনতা হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৩টি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। আগের দিন সন্ধ্যায় অভিযুক্ত কিশোরের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়।

এদিকে হামলার ঘটনার প্রভাব পড়েছে এলাকার শিক্ষা কার্যক্রমেও। ঘটনার পরদিন আলদাদপুর গ্রামের দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলদাদপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীদের দেখা মেলেনি। আতঙ্কে অনেক পরিবারই সন্তানদের স্কুলে পাঠায়নি বলে জানান স্থানীয়রা।

আলদাদপুর নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালী রঞ্জন রায় বলেন, এই বিদ্যালয়টির বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তারা কেউ স্কুলে আসেনি। অনেক শিক্ষার্থী তাদের পরিবারসহ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘দুপুরে (গতকাল) নামাজের পরে আবারও হামলার হুমকি পাওয়া যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে অনেক পরিবার বাড়ি ছাড়ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।’

গঙ্গাচড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল এমরান জানান, পরিস্থিতি এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে রোববারের ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে আটকও করা হয়নি।

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, রোববারের ঘটনার সঙ্গে কিশোরগঞ্জের মাগুরা ইউনিয়নের কিছু মানুষ জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে খিলালগঞ্জ বাজারে সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়ন আছে, যাতে তারা আবার ঢুকতে না পারে।

তিনি আরও বলেন, রোববার রাতে জেলা পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ১৪-১৫টি বাড়ির ক্ষতি ও লুটপাটের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের আর্থিক বা অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক তিন এমপিসহ নতুন মামলায় গ্রেপ্তার ৫

ঝালমুড়ি বিক্রেতার এক মাসে বিদ্যুৎ বিল ১১ লাখ টাকা

মহাসড়কে বসে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের

আওয়ামী মিডিয়া ডনদের গ্রেপ্তার করতে হবে : রাশেদ প্রধান

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ী নিহত

‘চাকরিচ্যুত, জেলহাজতে, পলাতক’ শিক্ষকদের তথ্য চাইল শিক্ষা দপ্তর

আগামী ৫ দিন কেমন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতিবিষয়ক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত

আ.লীগ নেত্রী পাখি গ্রেপ্তার

১৮ বলের ‘ওভার’! হেস্টিংসের কারিশমায় ম্যাচই শেষ

১০

কিস্তির টাকা নিয়ে বিরোধে চাচার ঘুষিতে প্রাণ গেল ভাতিজার

১১

৪ দফায় সুনামি আছড়ে পড়ল রাশিয়ায়

১২

প্রেম গুঞ্জনে কেটি পেরি ও জাস্টিন ট্রুডো

১৩

সেই রিয়াদের বাসায় অভিযান, চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল ডিএমপি

১৪

কমিউনিটিভিত্তিক মডেলে মাঠ ও পার্ক ব্যবস্থাপনা করবে ডিএনসিসি

১৫

সিডিসি জালিয়াতির মূল হোতা রহস্যজনকভাবে এখনো বহাল

১৬

জ্যোতির দাফন সম্পন্ন, ‘আম্মু ওঠো’ বলে যমজ সন্তানের আহাজারি

১৭

স্কুলছাত্র সুমেল হত্যায় ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন 

১৮

ভূমিকম্পের পর সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, ছাইয়ে ঢেকে গেছে আকাশ

১৯

বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্রেই ভয়াবহ লোডশেডিং, স্থানীয়দের ক্ষোভ

২০
X