কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী সীমান্তের কালজানী নদী হয়ে নাগেশ্বরীর দুধকুমার নদে দুদিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেসে এসেছে কয়েক হাজার গাছের গুঁড়ি। এসব গাছের গুঁড়ি বাকল ও শিকড়বিহীন এবং দেখতে লাল বর্ণের হওয়ায় উৎসুক জনতা ‘রক্ত চন্দন’ ভেবে ভিড় করছেন। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তীব্র স্রোতের মধ্যে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এসব গাছের গুঁড়ি তীরে নিয়ে আসছেন। এরপর সেগুলো ‘চন্দন কাঠ’ হিসেবে বিক্রি করছেন। অনেকে না বুঝে সেগুলো কিনছেন। উৎসুক জনতার এমন কাণ্ড দেখে এসব কাঠের গুঁড়ি একেকটি ২০ থেকে ৩৫ হাজার দাম হাঁকাচ্ছেন। কেউ কেউ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম চাচ্ছেন। তবে জেলা বন বিভাগ বলছে, মানুষজন না বুঝেই এসব কাঠের গুঁড়ি শ্বেত বা রক্ত চন্দন ভেবে বেচাকেনা করছেন।
এরই মধ্যে এসব গাছের গুঁড়ি উঠাতে গিয়ে গত রোববার উপজেলার বেরুবাড়ি ইউনিয়নের খেলারভিটায় খামার নকুলা গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে মনছুর আলী (৪০) ডুবে মারা গেছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকে আর এসব গুঁড়ি ভেসে আসেনি। আগের দুদিন ভেসে আসা গুঁড়িগুলো মূল্যবান ভেবে কালজানী ও দুধকুমার নদের পাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। একেকটি গুঁড়ির আকার ও পরিমাপ ভেদে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। আর যেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে সেগুলো মণ হিসেবে বিক্রি করছেন।
এর আগে গত দুদিন দেখা যায়, উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের নুনখাওয়া, বেরুবাড়ি ইউনিয়নের খেলারভিটা, রায়গঞ্জের বড়বাড়ী, বামনডাঙ্গার আয়নালের ঘাট, আদর্শ বাজার, মুড়িয়া, পাচমাতা, তেলিয়ানী, কালীগঞ্জ ইউনিয়নের সিঅ্যান্ডবি ঘাট পর্যন্ত দুধকুমারের দুই তীরে অসংখ্য মানুষ কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ সাঁতরিয়ে গাছগুলো নদের কিনারে আনছেন।
বামনডাঙ্গা তেলিয়ানীর স্কুল শিক্ষক ওছমান গণি জানান, গত শনিবার গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের শোরগোল ও চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙে তার। ভেবেছেন চোর পড়েছে গ্রামে। দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে শব্দের উৎস খুঁজতে দুধকুমারের কিনারে গিয়ে দেখেন দুই দিকে যতদূর চোখ যায়—শুধু মানুষ আর মানুষ। আলোয় আলোকিত নদের তীর। এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান লোকজন যেমনভাবে পারছে তেমনভাবেই লাফিয়ে পড়ছে নদীতে। সাঁতরিয়ে ধরে আনছেন আস্ত এক একটি গাছ। সকাল হতেই নদের দুই পাশে গাছের স্তূপ জমে যায়।
স্থানীয়রা জানান, কয়েক হাজার ভেসে আসা এসব গাছের গুঁড়ি জ্বালানি হিসেবে এর বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
পাশের রায়গঞ্জ ইউনিয়নের দামাল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘চারজন মিলে ৫০ ফুটের এই লাল গাছটা উঠাইছি। আরও ছয়জন সাহায্য করছে। এটা রক্ত চন্দনের গাছ। ১ লাখ ২০ হাজার হলে বিক্রি করব।’
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবিদ মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সার কাঠে প্রচুর ট্যানিন এবং ফেনলিক যৌগ থাকে। যখন কাঠ পানিতে ভিজে, তখন এই যৌগগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বের হয়। ট্যানিন অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে অক্সিডেশন ঘটায় এবং লালচে-বাদামি রং তৈরি করে। প্রকৃত পক্ষে এগুলো চন্দন কাঠ নয়।’
জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা রোববার সরেজমিন এসব গাছের গুঁড়ি দেখেছি। দীর্ঘদিন এসব পানিতে থাকায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে শ্বেত বা রক্ত চন্দনের কোনো বিষয় নেই। লোকজন না বুঝেই এসব কিনছেন এবং বিক্রি করছেন।’
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিব্বির আহমেদ জানিয়েছেন, উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে বিশাল পরিমাণ কাঠের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এই কাঠ ধরতে গিয়ে স্থানীয়রা বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে কাঠের সঙ্গে সাপের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। তাই তিনি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন