

হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল আর নদী সমৃদ্ধ মৌলভীবাজার জেলার জলাশয় ও নদীগুলো পলি পড়ে ভরাটের কারণে নাব্য হারাচ্ছে। কুলাউড়াসহ তিন উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মনু জেলার প্রধান নদ। পলি পড়ে ভরাট হয়ে পানির ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে এ নদের। বর্ষায় নদের পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যার কবলে পড়তে হয় দুই পাড়ের বাসিন্দাদের। আর শুষ্ক মৌসুমে দেখা দেয় পানির সংকট। এ ছাড়া নদের ঢহর (গভীরতম স্থান) ভরাট হয়ে মাছের উৎপাদন কমেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত থেকে আসা মনু নদ কুলাউড়ার শরীফপুর থেকে শুরু হয়ে মৌলভীবাজারের মনুমুখ এলাকায় কুশিয়ারায় গিয়ে মিশেছে। ২০২২ ও ২০২৪ সালের পরপর দুবারের ভয়াবহ বন্যায় ও দীর্ঘদিন নদী খনন না করায় নাব্য হারাচ্ছে। বন্যায় জমে থাকা পলিতে এই অঞ্চলের বসতবাড়ি, কৃষিজমি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। একাধিকবারের বন্যায় ভারতের উজান থেকে পানির সঙ্গে পলিতে ভরাট হওয়ায় নদের গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। নদের বিভিন্ন স্থানে জেগেছে চর।
বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের কারণে বেড়িবাঁধে ভাঙনসহ বন্যার সৃষ্টি হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে নাব্য হারায়, পানি কমে যায়। এ ছাড়া দেশীয় মাছের যেমন উৎপাদন কমেছে, তেমনি কৃষকসহ আশপাশ এলাকার মানুষ নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই নদ খননের দাবি জানিয়েছেন উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ।
সরেজমিন দেখা যায়, মনু নদের পৃথিমপাশা, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নের ধলিয়া, সুখনাভী, রাজাপুর, কটারকোনা, ইসমাইলপুর, রনচাপ, নিশ্চিন্তপুরসহ বিভিন্ন স্থানে জেগেছে চর। এসব চরের কারণে গত বর্ষায় বেড়িবাঁধের শিকরিয়া এলাকায় প্রায় ৩০০ ফুট ভাঙন দেখা দেয়। এ ছাড়া ২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যায় মিয়ারপাড়া, সন্দ্রাবাজ ও শালন এলাকায় নদীভাঙনে কুলাউড়া উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। জমে থাকা পলির কারণে নদের তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্য হারাচ্ছে। পলি ভরাটের ফলে নাব্য কমায় মাছের উৎপাদন হ্রাসসহ আশপাশে লোকালয়ের ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা সেচের পানির সংকটে পড়েছে।
নদীতীরবর্তী এলাকার স্থানীয় কৃষক তানভীর আহমদ, তাজু মিয়া, মোবারক আলী, ইসমাইল আলী, আব্বাস আলী, ফরিদ আহমদসহ কয়েকজন জানান, পলির কারণে মনু নদ ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন থেকে খনন না করায় বর্ষায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে বন্যার কবলে পড়ি। এজন্য আমাদের কৃষিজমি ও ফসলের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া এই নদে এক সময় ব্যাপক হারে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে পলির কারণে নদীর ঢহর (গভীরতম স্থান) ভরাট হয়ে মাছের উৎপাদন কমেছে। নদীর ঢহরে পানি না থাকায় জাল ও বড়শিতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। নদী খননে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
রাজাপুর খেয়াঘাটের মাঝি রুবেল আলী ও ধলিয়া ঘাটের মাঝি হারুন মিয়া বলেন, নদে এখন আর আগের মতো গভীরতা নেই। পলি জমায় গভীরতা কমায় নৌকা চালানো যায় না। শুকনো মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে ও হেঁটে এলাকার লোকজন নদী পারাপার হন। গভীরতা কম থাকায় বর্ষায় পানি বৃদ্ধি পেলে বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সব দিকেই এখন বিপদ।
কুলাউড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবু মাসুদ বলেন, পলি মাটির কারণে প্রতি বছর মনু, ফানাই ও হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন বিল ভরাট হওয়ায় পানির ধারণ ক্ষমতা কমছে। এ জন্য দেশীয় মাছের উৎপাদনও কমেছে। মনু নদের ভারতীয় সীমান্তের ওপরিভাগ থেকে কটারকোনা সেতু, ফানাই নদী ও হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া অংশের কাংলী বিল খননের প্রস্তাব মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মহিউদ্দিন বলেন, জমে থাকা পলি অপসারণ, বেড়িবাঁধ মেরামত ও নদী খননের জন্য স্থানীয়রা আবেদন করেছেন। নদীর নাব্য ফেরাতে ড্রেজিং ও খননের বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, মনু নদের কয়েকটি স্থানে বিগত সময় জেগে ওঠা চর অপসারণ করা হয়েছে। বিগত দুবারের বন্যার পর নতুন করে জাগা চর অপসারণ ও নদী খননের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হবে।
মন্তব্য করুন