

মাতৃমৃত্যু রোধে কার্যকর ‘সায়েবাস মেথড’ কিট এবার যাচ্ছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে। সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর একটি কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই কিটকে মেডিকেল ডিভাইস হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড নামে দেশি কোম্পানির অনুকূলে এ অনুমোদন প্রদান করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বল্পমূল্যের এই উপাদানটি দেশ-বিদেশে অসংখ্য প্রসূতির জীবন রক্ষা করেছে। আবিষ্কারের প্রায় ২৫ বছর পর এটি মেডিকেল ডিভাইস হিসেবে স্বীকৃতি পেল। এটি বাজারে প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া গেলে জরুরি সময়ে অনেক মূল্যবান জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
অনুমোদনপত্রে বলা হয়েছে, ফোলি ক্যাথেটার উইথ বেলুন নামে পরিচিত ইন্ট্রাইউটেরিন ট্যামপোনাডে ডিভাইসটি নিবন্ধনের আগে ২০০ জন রোগীর ওপর ব্যবহার করে সেফটি পারফরম্যান্স রিপোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যে দাখিল করতে হবে। অনুমোদন এক বছরের জন্য কার্যকর থাকবে এবং ফি দিয়ে আরও এক বছর বাড়ানো যাবে। অনুমোদনপত্রে আরও উল্লেখ রয়েছে, নিবন্ধনের আগে এই ডিভাইস বাজারজাত করা যাবে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, রেসিপি অনুমোদনের পর ডিভাইসটির মূল্য নির্ধারণে কাজ শুরু হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের পরই এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসবে।
এই কিটের উদ্ভাবক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘এই পদ্ধতি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের অনেক দেশের প্রসূতিদের জীবন রক্ষা করছে। একটি কনডম ও একটি ক্যাথেটার ব্যবহার করে জরায়ুতে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা হয়, যা অসংখ্য প্রাণ বাঁচিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জরুরি সময়ে এই কিট তৈরি করতে দেরি হয়, ফলে ঝুঁকি বাড়ে। তাই প্রস্তুত ডিভাইস থাকলে তাৎক্ষণিক প্রয়োগ সম্ভব হয় এবং রক্তক্ষরণ কমে যায়।’ ডিভাইসটির দাম যেন ৫ ডলারের মধ্যে থাকে, সে অনুরোধও তিনি করেছেন।
জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের আবেদনের ভিত্তিতে ঔষধ প্রশাসন রেসিপি অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই ডিভাইসের চাহিদা থাকলেও, স্বল্পমূল্যের কারণে কেউ আগ্রহ দেখায়নি।’
একটি ক্যাথেটার, একটি সাধারণ কনডম এবং স্যালাইন দিয়ে তৈরি এই কিট ৯৩ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রসূতির জীবন রক্ষা করেছে। একটি ক্যাথেটারের মাথায় একটি কনডম বেঁধে সেই কনডম জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ক্যাথেটারের অন্য প্রান্তে স্যালাইন লাগানো হয়। পানি ঢোকার কারণে কনডম বড় হতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে। এভাবে ২৪ ঘণ্টা রাখা হয়। এরই মধ্যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ২ দশমিক ৯১ থেকে ৩ দশমিক ০৭ লাখ মাতৃমৃত্যু ঘটে, যার বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এই পদ্ধতি সেই বাস্তবতায় এক কার্যকর সমাধান হিসেবে কাজ করছে। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ান্স অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টস অধ্যাপক সায়েবা আক্তারকে এই উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে।
২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে প্রথম এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ কমাতে অত্যন্ত কার্যকর।
এখন এই পদ্ধতি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ সুদান, কেনিয়া, ঘানা, সেনেগাল, তানজানিয়া, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, হন্ডুরাসসহ বহু দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
মন্তব্য করুন