রাজধানীর মিরপুর-১ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচল করে তানজিল পরিবহন। গত বুধবার সন্ধ্যায় এক মধ্যবয়সী কর্মজীবী নারী অফিস শেষে শাহবাগ থেকে সদরঘাটের উদ্দেশে তানজিল পরিবহনে ওঠেন। বাসটিতে সংরক্ষিত নারী আসনে কয়েকজন পুরুষ বসে থাকায় পুরো পথ তাকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার কলতাবাজার এলাকায় তার বাসা। কাজ করেন মিরপুর-১-এ একটি প্রতিষ্ঠানে। তাই সদরঘাট থেকে মিরপুর-১ পর্যন্ত নিয়মিত বাসে চলাচল করতে হয়। কিন্তু বাসে বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কারণ নারীদের সিটে পুরুষ বসে থাকে। কখনো খুব খারাপ লাগলে বলি—ভাই নারী সিটটা ছেড়ে দেন। কেউ ছাড়ে আবার কেউ বসে থাকে, বাগবিতণ্ডায় জড়ায়। এমন ভোগন্তিতে প্রতিনিয়ত পড়তে হয় রাজধানীর গণপরিবহনে চলাচলকারী নারী কর্মজীবী ও শিক্ষার্থীদের।
মহানগরে চলাচল করা অধিকাংশ গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৯টি আসন বরাদ্দ; কিন্তু বাস্তবে এই সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গণপরিবহনে চলাচল করা কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীরা।
গুলিস্তান থেকে ধামরাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেওয়া ডি-লিংক পরিবহনে দেখা যায়, বাসে ড্রাইভারের বাম পাশে লম্বা বেঞ্চের মতো যে সংরক্ষিত আসন রয়েছে সেখানে পণ্য রাখা হয়েছে। এ কারণে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ড্রেস পরিহিত কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী বাসে দাঁড়িয়ে আছে। আজমেরী গ্লোরি, ভিক্টর ক্ল্যাসিক, বিহঙ্গ পরিবহন, সাভার পরিবহন, বিকাশ পরিবহন, মৌমিতা পরিবহনসহ রাজধানীর বেশিরভাগ গণপরিবহনে এ চিত্র দেখা যায়।
জনবহুল ঢাকা শহরে গণপরিবহনে ওঠানামা করতে নারীদের রীতিমতো পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়। যখন বাসে যাত্রী বেশি থাকে তখন বাসগুলো গেটলক করে রাখা হয়। ফলে বিপাকে পড়তে হয় নারীদের। কোনো গণপরিবহনে যদি কোনো নারী উঠে পড়েন, তাকে নানা কটুবাক্য শুনতে হয়। বিষয়টা এমন যে, নারীদের রাস্তায় বের হওয়াটাই যেন দোষের। যদিও সর্বোচ্চ আদালত নারীদের জন্য বাসে ৯টি আসন বরাদ্দ দিয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় খুব কম।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ৩৫.৬ শতাংশ। এই নারীদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত। অধিকাংশই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন। কোনো নারী বাসে উঠলে পুরুষরা এমনভাবে তাকায়, মনে হয় সেই নারী ভয়াবহ কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন।
গণপরিবহনে চলাচল করা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী আনুশকা বলেন, সংরক্ষিত আসন তো দূরের কথা, সামান্য যাত্রীতে ভরা গাড়িতে উঠতে চাইলে হেলপার বলে মহিলা নিই না। আবার কখনো উঠতে পারলে সিট পাই না। সংরক্ষিত আসনে বসে থাকে পুরুষ। যদি বলি ওটা তো নারীদের আসন, তখন শুনতে হয় নারী-পুরুষের সমান অধিকার চান আর পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, দাঁড়িয়ে থাকলে ইচ্ছাকৃত কিছু পুরুষ ধাক্কা দেয়। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে উল্টো হেলপার বলে—‘আপা ঝামেলা করিয়েন না তো’।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। নারীরা যে পুরুষদের সহকর্মী সেটা বোঝা উচিত সমাজের। গণপরিবহনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রায়ই দেখা যায়, সংরক্ষিত আসনে পুরুষ বসে আছে। এসব পুরুষ ড্রাইভার, হেলপারদের বলছে নারীদের গাড়িতে না তুলতে। এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নারীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের জন্য ৩৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ করা জরুরি। এটা বাস্তবায়নে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গণপরিবহনে ৩০ শতাংশ মহিলা আসন সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পরে বিধান করা হয়—ছোট বাসে ৬ এবং বড় বাসে ৯টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯২(২) ধারা অনুযায়ী, যদি সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসেন, তাহলে এক মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। তবে এ আইনে শাস্তি দেওয়ার নজির নেই বললেই চলে।