চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ইছামতী আলীনগর এলাকার পরিবেশ সোমবার থেকেই ভারি হয়ে উঠেছে। থামছে না ষাটোর্ধ্ব গুলচাম্পার আহাজারি। তার সঙ্গে বিলাপ করে কান্না করছেন ছোট্ট দুই সন্তানের জননী রুমি আক্তার। চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার চার বছর বয়সী ছেলে সাইফুল ইসলাম ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে মেহেরিমা জান্নাতকে বোঝাবে কে! তাদের ভবিষ্যৎ চলবে কীভাবে!’
সোমবার বিকেল ৩টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলঘরের বরগুনি সেতু এলাকায় পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে বালুবোঝাই একটি ট্রাকের ধাক্কা লেগে আবদুস সবুরের অটোরিকশার সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তিনি দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। ঘটনার দিন রাতেই স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোমবার থেকেই মো. আবদুস সবুরের (৩৯) ছবি ও ভিডিও ঘুরছে। অটোরিকশায় পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছেন একজন মানুষ। তাকানো যায় না, সহ্য হয় না; তবু ভাইরাল এই ছবি দেখতে হয়েছে অনেক নেট ব্যবহারকারীকে। সেই ছবির কথা ভেবেই বুঝি ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠছিলেন আবদুস সবুরের মা গুলচাম্পা ও স্ত্রী রুমি আক্তার।
গতকাল মঙ্গলবার দিনভর পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় করেছিলেন আবদুস সবুরের বাড়িতে। তার অবুঝ দুই সন্তান সাইফুল ইসলাম ও মেহেরিমা জান্নাত এখনো বুঝতেই পারছে না, তাদের বাবা আর নেই। বাড়ির সামনের ছোট্ট গলিতে অন্য শিশুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তারাও দেখছিল লোকজনের আসা-যাওয়া। কিছুক্ষণ পর সাইফুল ইসলাম দাদির কোলে চড়ে বসে। তা দেখে মেহেরিমা জান্নাতও দাদির কোলে এসে বসে। তখনো দাদি গুলচাম্পা কান্না করছিলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে গুলচাম্পা বলেন, ‘বর্ষাকালে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। ছেলেটি আমাকে বলেছিল, এই সামনের রোজার ঈদের সময় কিছু অতিরিক্ত ভাড়া টেনে টাকা জোগাড় করবে। এরপর ওই টাকা দিয়ে ঘরের চালের টিন বদলাবে। এখন ছেলেটি আগুনে পুড়ে মরে গেল। ঘরের চালের টিন কে বদলাবে। আমি কার কাছে থাকব, কে আমাকে খাওয়াবে? ও বাপরে, ও বাপ, কোন দোষে এমন কয়লা হয়ে গেলি রে বাপ।’
আবদুস সবুরের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তার স্ত্রী রুমি আক্তার। সম্বিত পেলেই বিলাপ করছেন, ‘দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব। কে তাদের দেখবে!’
ঢেমশা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রিদুয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘সবুর ভালো লোক হওয়ায় এলাকার কিছু মানবিক মানুষ মিলে তাকে একটা সিএনজি কিনে দিয়েছিল। সবুর জ্বলল, তার অটোরিকশাও জ্বলল, সঙ্গে পুড়ল তার সাজানো সংসার। এখন সহায়-সম্বলহীন এই পরিবারকে মানুষ সহযোগিতা না করলে অভুক্ত থাকা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, যাত্রী নিয়ে পটিয়া থেকে সাতকানিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন আবদুস সবুর। চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া বরগুনি ব্রিজ পার হয়ে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তারা আটক করলে টাকা দিতে হবে–এই ভয়ে দ্রুত তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়ার সময় পেছন থেকে বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাক ধাক্কা দেয়। এতে পেছনে থাকা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায়। অটোরিকশায় আগুন ধরে যেতে দেখে পুলিশের গাড়িটি পালিয়ে যায়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন জড়ো হয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন। গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে জড়িতদের শাস্তি দাবি করা হয়। পুলিশের একটি গাড়ি অতিক্রম করার চেষ্টা করলে অবরোধকারীরা তা ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। পরে চন্দনাইশ থানা পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এ এন এম ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, এখন চেকপোস্ট বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। আর জেলা
ট্রাফিক পুলিশের বক্স আছে দোহাজারীতে। ঘটনাস্থল আরও এক কিলোমিটার দূরে। সবুজের নেতৃত্বে চেকপোস্ট বসানোর অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগের প্রমাণ পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবদুস সবুর নিহতের ঘটনায় টিআই দেলোয়ার হোসেন সবুজকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে নিহত আবদুস সবুরের ভাই আবদুল গফুর বাদী হয়ে চন্দনাইশ থানায় মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি খান মো. এরফান।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কালবেলার সাতকানিয়া সংবাদদাতা আব্দুল খালেক ও চন্দনাইশ প্রতিনিধি
খালেদ রায়হান]