২০২১ সালের জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ১১তলা বিশিষ্ট বর্ধিত ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পর দুই বছর মেয়াদের কাজ পাঁচ বছর হতে চলেছে, তবুও শেষ হয়নি। নির্মাণকাজে এমন ধীরগতির কারণে অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাকে দায়ী করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করোনা ও ডলার সংকটের অজুহাত দিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু হলের বর্ধিত ভবনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এক হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন ও হাউস টিউটরদের জন্য ২০টি ফ্ল্যাটসমৃদ্ধ ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৮৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত দরপত্র অনুযায়ী, নির্মাণকাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে চার দফায় সময় বৃদ্ধি করা হয়। ভবনের সামগ্রিক কাজের মেয়াদ সর্বশেষ ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় আগামী জুন পর্যন্ত। কিন্তু যেই গতিতে কাজ এগোচ্ছে, এই সময়ের মধ্যেও শেষ করা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছে তদারক কমিটি।
সম্প্রতি সরেজমিন নির্মাণাধীন ভবনে দেখা গেছে, অল্প কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ পলেস্তারা লাগাচ্ছেন, কেউ বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করছেন, কেউ করছেন টাইলসের কাজ। তারা বলেন, ভবনের সব কাজ শেষ হতে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত লেগে যাবে। ইলেকট্রিক, স্যানিটারি প্লাস্টার ও রডের কাজ বাকি। এ ছাড়া টাইলস করা কিছু অংশে ফের ফিনিশিংয়ের কাজ করতে হবে। এই মুহূর্তে ৩০ জনের মতো শ্রমিক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কাজ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৯ মার্চ ভবন নির্মাণকাজ তদারক কমিটির সভায় প্রকল্প মেয়াদ বাড়িয়ে ওই বছরের জুন পর্যন্ত করার সুপারিশ জানানো হয়। পরবর্তী সভায় আসবাব সংরক্ষণের জন্য ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হল ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার কক্ষগুলোর কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে ওই বছরের ২ এপ্রিল মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে ৩০ জুন করা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সভায় আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে সিভিল ওয়ার্কের কাজের মেয়াদ ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া ফ্লোর টাইলস, সেফটি গ্রিল, সুয়ারেজ লাইন, লিফট ও আনুষঙ্গিক বরাদ্দও কয়েক কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে, নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ও ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান বাবু বলেন, প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় বর্ধিত ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। শুনেছিলাম দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। সে অনুযায়ী শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়ই বর্ধিত ভবনে সিট বরাদ্দ পাব আশা করেছিলাম, কিন্তু সেটি হয়নি।
আরমান হোসেন নামে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ভয়াবহ আসন সংকটের মধ্যে ২০১৯ সালে কাজ শুরু হওয়ায় আশার আলো দেখেছিলাম। ওই বছর যারা ভর্তি হয়েছিলাম, তাদের মাস্টার্স শেষ করে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, অথচ সে কাজ এখনো শেষ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. ইব্রাহিম কালবেলাকে বলেন, ঠিকাদারদের কাজে যথেষ্ট ধীরগতি রয়েছে। এ কারণে কিছুদিন আগেও তাদের চিঠি দিয়ে কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুনেছি আজিমপুরেও কয়েকটি ভবনের নির্মাণকাজ করছে ঠিকাদারি কোম্পানিটি। সে কারণে বর্ধিত ভবনের দিকে নজর দিতে পারছে না।
তবে নির্মাণকাজে ধীরগতির জন্য উল্টো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, করোনা ও জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণকাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দুর্বলতা ছিল না।
হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন বলেন, নির্মাণে ধীরগতির পেছনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাই দায়ী। এ পর্যন্ত তারা কমপক্ষে ১০ বার ‘দ্রুত কাজ শেষ করা হবে’ বলে আশ্বাস দিয়েছে। তদারক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে কমপক্ষে ১৫ বার দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য তাদের চিঠি দিয়েছি এবং সভায় আসার অনুরোধ জানিয়েছি, কিন্তু তারা সভায় আসেন না।
জানতে চাইলে বর্ধিত ভবন প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ সাবের বলেন, সামগ্রিক প্রজেক্টের মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করে হস্তান্তর করতে পারব। তবে নির্মাণকাজে ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম সোহেল বলেন, করোনার কারণে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে বলবে, সেভাবেই আমাদের করতে হবে। ইলেকট্রিক্যাল জিনিস আমদানির ব্যাপারও আছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি করতে সমস্যা হয়েছে। তাই কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে তারা বরাদ্দ বাড়াতে বলেছিল। বরাদ্দ না বাড়ানোয় তারা ঠিকমতো কাজ করেনি। বিষয়টি নিয়ে সভা করেছি। তাদের দ্রুত কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, হলের বর্ধিত ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ কারণে ঠিকাদাররা কাজ ত্বরান্বিত করেছে।