নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে সাংবিধানিক অধিকার চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধৈর্য ধরে সরকারকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির কমিটির নেতারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি। এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এটা নিয়ে আর কোনো বিভেদ যেন না হয়। আমাদের গণতান্ত্রিক যে আকাঙ্ক্ষা, সেখানে আমরা বিবেচিত মুসলমান হিসেবে নয়, হিন্দু হিসেবে নয়, বৌদ্ধ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। আমাদের অধিকারগুলো নিশ্চিত হোক।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘ন্যায়বিচার হলে কে বিচার পাবে না? কার সাধ্য আছে, সেখানে বিভেদ তৈরি করার?’ নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে না দেখে গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন ইউনূস।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা বিভিন্ন খোপের (বিভেদ) মধ্যে চলে যাইয়েন না। এই খোপ হলে, খোপের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি লেগে যাবে। এক হয়ে আসেন। এক আইন, আমাদের আইনি অধিকার দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা আইনি অধিকার পান না, বিচার হয় না—এটাই হলো আসল জিনিস।
বিচার ব্যবস্থা আমাদের দিকে তাকায় না, পুলিশ আমাদের দিকে তাকায় না। কারণ, আমি অধিকারটা আদায় করতে পারি নাই। আমাদের নীতিটা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা যদি টেনে টেনে নিয়ে আসেন আমি অমুক, আমি তমুক, এটা আবার পুরোনো জায়গায় চলে গেল। আপনারা বলেন যে আমি মানুষ, আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমার সাংবিধানিক অধিকার এই, আমাকে দিতে হবে। সব সরকারের কাছে এটাই চাইবেন।’
বিগত বছরগুলোয় দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করা হয়েছে মন্তব্য করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, ‘সমস্ত সমস্যার গোড়া হলো আমাদের যত প্রতিষ্ঠান আছে সবকিছু পচে গেছে। এ কারণেই এই গোলমালগুলো হচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচার হলে কে বিচার পাবে না, আমাকে বলেন। কোন ধর্মের, কোন জাতের, আইনে কি বলা আছে যে, মুসলমান সম্প্রদায় হলে এই আদালতে হবে, হিন্দু সম্প্রদায় হলে ওই আদালতে যাবে। সবার জন্য আইন একটা, কার সাধ্য আছে সেখানে বিভেদ করে, এ রকম একটা, ওই রকম একটা।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা এমন রোগ, মূলে যেতে হবে। আপনারা যদি বলেন আমাদের সংখ্যালঘুরা, এটা বললে মূল সমস্যা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। বলতে হবে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটা পেলে আমার বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটিই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, ‘যারা খোপ খোপ করতে আরম্ভ করবেন, তারাও মজা পেয়ে যাবেন। ওই মজার খেলায় আমাদের আর নিয়ে যাইয়েন না। আমরা এসেছি, আমরা এক মানুষ, আমাদের এক অধিকার। এর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না।’
সবার সহযোগিতা চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘একটু সহযোগিতা করেন আমাদের, একটু ধৈর্য ধরেন। কী করতে পারলাম, কী পারলাম না সেটা পরে বিচার কইরেন। যদি না পারি আমাদের দোষ দেবেন।’
এর আগে সনাতন ধর্মের নেতারা বিভিন্ন সময় তাদের ওপর হামলার কথা তুলে ধরেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছে এসব সমস্যার স্থায়ী প্রতিকার চান তারা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে তাদের আশ্বাস দেন।
বাংলাদেশকে ‘একটি পরিবার’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করা বা বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না।’