ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় ততটুকু জমির মালিক সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবড়ি ও মঠবাড়ী ইউনিয়নের রায়মনি এলাকায় অবস্থান হামিদ রিয়েল এস্টেটের প্রজেক্ট। নরদা বিলে একটি জলাশয়ের প্রায় পাঁচশ বিঘা জমি তার দখলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ, মামলা-হামলা ও ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভয় দেখিয়ে গ্রামের সাধারণ কৃষকের এসব জমি দখল করেছেন। নরদা বিলে জমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার একরের ওপরে। সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই সম্পদ গোপন করতে বিলে থাকা শতাধিক হামিদ রিয়েল এস্টেট নামের সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ত্রিশালের নরদা বিলে যতদূর চোখ যাচ্ছে তার সবটুকু জমির মালিক সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, যতটুকু জমি কেনা হয়েছে তার থেকে বেশি জমি দখল করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ১৫৪ বিঘা জমির নামজারি করেছেন নসরুল হামিদ। জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় একশ কোটি টাকা। ত্রিশালের নদরা বিলে শুকনো মৌসুমে ধান চাষ আর বর্ষায় দলবেঁধে মাছ ধরতেন গ্রামের মানুষ। হতো নৌকাবাইচও। এখন যা সোনালি অতীত।
আমিরাবড়ি ইউনিয়নের রায়মনি এলাকার বৃদ্ধ রমিজা খাতুন বলেন, আমার নামে জমির দলিল থাকা সত্ত্বেও জোর করে জমি দখল করে নিয়ে গেছে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে। এই জমি আমার মা আমাকে দলিল করে দিয়েছিলেন।
আমার জমিতে মাটি দিয়ে ভরাট করার পর টিনের ঘর করতে চেয়েছিলাম। তখন আমাকে বাধা দিয়ে ঘর করতে দেওয়া হয়নি। বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, এই জমি দলিল হয়ে গেছে। দালালের মাধ্যমে জাল দলিল করে আমার এই সম্পদ লিখে নিয়ে গেছে নসরুল হামিদ। আমার জমি দখল করে নিয়ে গেছে।
আমিরাবড়ি ও মঠবাড়ী ইউনিয়নে নরদা বিলে থাকা এক হাজর একর জমি রয়েছে। সেই বিলের পুরো জমির নিয়ন্ত্রণ এখন নসরুল হামিদের হাতে। পুরো বিলেই নসরুল হামিদের মাছ চাষ হয়। স্থানীয় সাধারণ মানুষের জোঁ নেই।
আমিরাবড়ি ইউনিয়নের নারায়ণপুরের সোহেল মিয়া বলেন, হামিদ গ্রুপের প্রতিনিধি দুলাল ও আরসা এই দুই দালালের মাধ্যমে আমার ও আমার দাদা ইমান আলী আকন্দের দুই একর পঁচানব্বই শতাংশ জমি জোর করে দখল নিয়ে গেছে। জমির টাকা আজ দেব, কাল দেব বলে ঘুরাচ্ছে তিন থেকে চার বছর ধরে। জমিতে যেতে চাইলে আমার নামে মাদক মামলার ভয়ভীতি দেখায়। পুলিশ নিয়ে এসে আমাদের হয়রানি করে। আমাকে ঘর থেকে এনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হবে এমন হুমকি দিয়েছে।
একই ইউনিয়নের খাগাটি গ্রামের মিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রায় ২ একর জমি জোরপূর্বক দখলে নেয়। বিষয়টি নিয়ে ভূমি অফিসে মিসকেইসের আবেদন করি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নসরুল আমিন পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে।
হামিদ ইকোনমিক জোন লিমিটেডের কেয়ারটেকার আইয়ুব আলী বলেন, আন্দোলনের দুই দিন পরে ঢাকা থেকে অর্ডার আসে সাইনবোর্ডগুলো তুলে ফেলার জন্য। মন্ত্রীর নাম থাকায় (হামিদ ইকোনমিক জোন লিমিটেড) রাস্তার পাশে থাকা সাইনবোর্ডগুলো কালো কালি দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। বাকি সাইনবোর্ডগুলো তুলে নিয়ে রুমে রেখে দিয়েছি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমাদের মালিকের খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
নারায়ণপুর গ্রামে সাখাওয়াদ হোসন বলেন, নর্থ থিলে আমার ১০ একর জমি ছিল। আমি হামিদ গ্রুপের কাছে ৪ একর জমি বিক্রি করি। এখনো ওই বিলে আমার ৬ একর জমি রয়ে গেছে। জোরপূর্বক ভয় দেখিয়ে আমার জমি দখল করে আছে। আমার জমিতে যেতেও দিচ্ছে না, চাষাবাদ করতে পারছি না। একপর্যায়ে আনোয়ার হোসেন (দুলাল) ও আসাদুল হক (আরসা) দালালের মাধ্যমে আলোচনা হয় জমি বিক্রি করে দেব। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই জমির কোনো টাকা দেয়নি। কিন্তু জোরপূর্ব দখলে নিয়ে গেছে।
সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া প্রজেক্ট ম্যানেজার জসিম উদ্দিসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ময়মনসিংহের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাহফুজুল আলম মাসুম বলেন, ‘রাজস্ব শাখায় তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ত্রিশালের আমিরাবড়ি ও মঠবাড়ী ইউনিয়নে দুটি খতিয়ানে সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর (হামিদ রিয়েল এস্টেটের মালিকানাধীন) আমিরাবড়ি মৌজায় ৪১ দশমিক ৯৪ একর জমি ও অপর একটি মৌজায় ৭ দশমিক ৭৩ একর জমি এবং মঠবাড়ী মৌজায় ১ দশমিক ২১ একর জমি নামজারি রয়েছে।’