ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আবুল কালাম আজাদ হন রাজশাহীর বাগমারার পৌর মেয়র। পদে বসেই হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া। তিনবার মেয়র থাকাকালে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তিনি করেননি। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, জায়গা-জমি দখলসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে শুরু করে জড়িয়েছেন খুনখারাবিতেও। গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। এরপর গত নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি হন ‘সর্বগ্রাসী’ কালাম। এরপর গত সাত মাসেই সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে ওই উপজেলায় প্রায় ৫০০ বিঘা জমি ও পুকুর দখল এবং নামে-বেনামে পৌরসভার ঠিকাদারির কাজ বাগিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এভাবেই অবৈধ সম্পদ গড়তেই তিনি এলাকায় চালাতেন ‘ত্রাসের রাজত্ব’।
জানা যায়, বাগমারার তাহেরপুর সুপার মার্কেটের জায়গা দখল করে বিক্রি করে প্রকৃত জমির মালিককে না দিয়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অন্তত ৫ কোটি টাকা নিয়েছেন কালাম। তার আগে সেখানে ছিল হরিজন (সুইপার) পল্লি। তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করলেও অন্যত্র পুনর্বাসন করা হয়নি। সরকারি খাদ্য গোডাউন ভেঙে সেখানে মার্কেট নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন ছিল। তবে মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার নাম করে বহু মানুষের থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তাহেরপুর পৌর এলাকার হরিতলা মোড়ে সড়ক বিভাগের জায়গা দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে সেখানে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই মার্কেটে কে কে (কালাম-কুস্তরী) ফ্যাশন হাউস নামে বড় একটি শোরুম নিজের মালিকানায় করেছেন তিনি। তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সামনে শতাধিক দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়। তবে ভাড়া ও দোকান বরাদ্দের অর্থ কখনো পৌরসভার অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। শুধু তাই নয়, তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সামনে শিক্ষক কোয়ার্টার দখল করে তিনি ভবন নির্মাণ করছেন। তাহেরপুর ভূমি অফিসের জায়গা ও পাশের পুকুর দখলে নিয়ে তা ভরাট করে গড়ছেন তিনতলা বাড়ি।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, কালাম এমপি হওয়ার পর সাত মাসে পুরো বাগমারা এলাকায় অন্তত ৫ হাজার বিঘা ফসলি জমি দখলে নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছেন। সেখান থেকে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এমপি হওয়ার পর অবাধে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করায় এলাকায় এমপি কালামের নাম হয়ে গেছে ‘ভেকু কালাম’।
তাহেরপুর পৌর এলাকার বাসিন্দারা জানান, কালাম মেয়র থাকা অবস্থায় তাহেরপুর বাজারে অন্তত ৮ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি দখল করে নেন। ওই জায়গা তাহেরপুর মন্দিরের নামে থাকলেও কালাম মেয়র হয়ে তা দখল করে পাঁচতলা মার্কেট গড়ে তোলেন। তিনি পৌরসভার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি মূলত তার সহযোগীদের লাইসেন্সে তিনি নিজেই করতেন। এভাবে তিনি তিন মেয়াদে মেয়র থাকাকালে শুধু পৌরসভা থেকেই ঠিকাদারি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এভাবে সব মিলিয়ে অবৈধভাবে কালাম এখন অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক। এ ছাড়া গ্রামে তার একটি দোতলা আলিশান বাড়ি রয়েছে। রাজশাহী শহরের বড় বনগ্রাম এলাকায় রয়েছে ১০ কাঠা জমি। রাজশাহী নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় এবং ঢাকায় রয়েছে তার একাধিক ফ্ল্যাট। তার নিজের মালিকানায় রয়েছে দুইশ বিঘা আয়তনের ৩০টি পুকুর। লিজ নিয়ে প্রায় পাঁচশ বিঘা পুকুরে মাছ চাষ করেন কালাম। এগুলোর মূল্য ৫০ কোটি টাকার মতো। গ্রামে কিনেছেন ৪০ বিঘা জমি। টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার ব্র্যান্ডের দেড় কোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে চড়েন তিনি। এ ছাড়া তার আরও দুটি বিলাসবহুল প্রাইভেটকার রয়েছে।
শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর বাগমারার ঐতিহাসিক খয়রার বিল দখলে নিতে তিনি ও তার মদদপুষ্ট উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মকবুল মৃধার লোকজন আশরাফুল ইসলাম নামের এক জেলেকে গুলি করে হত্যা করে। সে হত্যা মামলাটি এখনো চলমান। অথচ এই খয়রার বিল আরও বড় করতে এমপি হওয়ার পর কালাম বিলের চতুর্পাশে প্রায় ২০০ বিঘা জমি দখলে নিয়ে পুকুর খনন করেছেন।
২০১৬ থেকে গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সভাপতি থাকাবস্থায় অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কামিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় তাহেরপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনসুর মৃধার বাসায় ডেকে নিয়ে কালাম দেড় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতি আর ত্রাসের রাজত্ব চালাতে কালাম নিজের ঘনিষ্ঠ সাতজনকে নিয়ে ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপ তৈরি করেন। তারা হলেন কালামের ভাতিজা হাবিবুর রহমান হাবু, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনসুর মৃধা, সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা, রাজু আহম্মেদ, আনোয়ার হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা রতন সাহা।
জানা গেছে, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ২০০৮ সালে বাগমারা আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর তিন বছর পর কালাম সাবেক বিতর্কিত এমপি এনামুলের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। বাগমারার ১৫টি ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ নেন এনামুল। আর কালামের নিয়ন্ত্রণে ছিল দক্ষিণ বাগমারা বলে পরিচিত তাহেরপুর ও গোয়ালকান্দি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন পৌর মেয়র কালাম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। জয়ী হয়ে তিনি তাহেরপুর পৌরসভায় স্ত্রী সায়লা পারভীন কুস্তুরীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করেন। কালামের ভয়ে অন্য কেউ আর মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পাননি।
বাগমারা উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক সরকার বাবু ওরফে আর্ট বাবু বলেন, আমি নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নিতে চেয়েছিলাম। তবে কালাম ও তার সশস্ত্র বাহিনী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ফলে আমার মতো অন্যরাও নির্বাচনে অংশ নেননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তাহেরপুরের সমন্বয়ক সোহেল রানা বলেন, ‘পৌরসভার নামে অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গা জোরপূর্বক দখল করে বিভিন্ন মার্কেট গড়ে তুলেছেন কালাম। এসব মার্কেটে প্রায় ১০০-১৫০টি দোকান রয়েছে। প্রতি দোকান থেকে ৭-৮ লাখ করে টাকা নিয়ে নিজের ও স্ত্রীর পকেটে ভরেছেন। সংখ্যালঘুদের ১৮টি বাড়িঘর দখল করে নিয়েছেন কালাম। বিচার চাইতে গেলে উল্টো নির্যাতন করা হয়েছে। এভাবেই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কালাম জিরো থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’
আশরাফুল ইসলাম নামে তাহেরপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের গডফাদার কালাম ও তার স্ত্রী লেডি সন্ত্রাসী সায়লা পারভীন কুস্তুরী সরকারি খাদ্য গোডাউন ভেঙে দিয়ে সেখানে নিজের নামে মার্কেট তৈরির পাঁয়তারা করেছিলেন। ওই মার্কেটে দোকান বরাদ্দের নাম করে কয়েক কোটি টাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এভাবে তিনি অনিয়ম-দুর্নীতি ও জোর-জবরদস্তি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’
তাহেরপুর এলাকার কল্যাণ কুমার বলেন, ‘আমার জমি বলতে কিছু নেই। ৫ শতক জমির ওপর শুধু পৈতৃক বাড়ি-ভিটা। সেটি আমার নিজের নামেই রয়েছে ৪০ বছর ধরে। এরপর হঠাৎ শুনি সেই জমি আর আমার নামে নেই, কালামের (এমপি) নামে হয়ে গেছে। ৪০ বছর থেকে ভোগ-দখল করে আসা বাড়ি-ভিটা কোনো কারণ ছাড়াই দখল করে নেওয়ায় অনেক কষ্ট পেয়েছি। কারও কাছে গিয়ে কোনো বিচার পাইনি। বেদখল হয়ে যাওয়া সেই বাড়ি-ভিটার কাগজ নিয়ে আমি এখন পথে পথে ঘুরছি। আমি কোনো মামলা করতে চাই না, শুধু আমার বাড়ি-ভিটা ফেরত চাই।’
হরিজন সম্প্রদায়ের সৌর বালা নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা ৮-১০টি পরিবার হরিজন পল্লিতে একই সঙ্গে ছিলাম। ২০১৮ সালে পৌর মেয়র থাকা অবস্থায় কালাম আমাদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে সেখানে সুপার মার্কেট নির্মাণ করে। আমাদের কোথাও পুনর্বাসনও করা হয়নি। তখন থেকেই আমরা রাস্তার পাশে ড্রেনের ওপর ময়লা-আবর্জনার মধ্যে বসবাস করছি।’
তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘সাবেক এমপি কালাম সবসময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতেন। সবসময় পিস্তল-বন্দুক নিয়েই থাকতেন। তার সঙ্গে ২০-২২ জন লোক থাকত, যাদের সবার কাছে ছিল অস্ত্র। তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো লোক ছিল না। কেউ কিছু বললে তাকে গুলি করার হুমকি দিত। এমনকি মাঝেমধ্যেই ধরে নিয়ে গিয়ে টর্চার করা হতো। তাহেরপুরের জামগ্রামে তার একটি টর্চার সেলও ছিল। সেখানে ধরে নিয়ে গিয়ে নিরীহ মানুষকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো।’
তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছাত্রাবস্থাতেই দেখেছি, কলেজের পাশেই একটি জমিতে ছাত্রাবাস ছিল। পরে সেখানে শিক্ষকদের থাকার জন্য ডরমেটরি করা হয়। হঠাৎ কালাম সেই ডরমেটরি থেকে শিক্ষকদের জোরপূর্বক বের করে দিয়ে তা ভেঙে সেখানে নিজের নামে বাড়ি নির্মাণ করছেন। অথচ সেটি কলেজের সম্পত্তি ছিল এবং কলেজের নামেই চেক ছিল। কলেজের পেছনে পুকুর ছিল। সেটিও দখল করে ভরাট করে দোকানপাট গড়ে তুলে নিজেই ভোগ করে আসছিলেন।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সাবেক এমপি কালাম তার পরিবার নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এরপর তার ও স্ত্রীর নামে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে তিনি কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ। তাই এসব অভিযোগের বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।