পাহাড়ে চলমান অস্থিরতার ধাক্কা লেগেছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ৭২ ঘণ্টার অবরোধে পণ্য পরিবহন না করতে পাড়ায় পচে যাচ্ছে সবজি ও মৌসুমি ফল। জ্বালানি তেলের অভাবে নানা সংকটে পড়েছেন পাহাড়ে বসবাসরতরা। তবে গতকাল সোমবার অবরোধ তুলে নেওয়ায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। এদিকে রাঙামাটির বৌদ্ধবিহারে ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন স্থানীয় ভিক্ষুরা।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘাতের ঘটনায় জুম্ম ছাত্র-জনতা তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এতে সমর্থন দেয় সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। গতকাল ছিল তাদের অবরোধের শেষ দিন। এদিন বান্দরবান থেকে ঢাকা, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যান চলাচল শুরু করে। উপজেলার সড়কেও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও শহরকেন্দ্রিক টমটম ও অটোরিকশা চলাচল করেছে। গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সড়কের মানিকছড়িতে সড়কে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করেন পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। অন্য উপজেলায় পিকেটিং না থাকলেও আতঙ্কের কারণে যান চলাচল বন্ধ ছিল। তবে সন্ধ্যার পর থেকে সব উপজেলার যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।
তিন দিনের অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে আটকা পড়ে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা মৌসুমি কাঁচামালের পণ্য। হঠাৎ করেই অবরোধ ও ধর্মঘটের কারণে ব্যবসায়ীরা এসব মালপত্র জেলার বাইরে পরিবহন করতে পারেনি। ফলে প্রায় ২ কোটি টাকার মালপত্র নষ্ট হয়। শহরের ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় বিভিন্ন উপজেলা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে আসা কলা, জাম্বুরা, পেঁপেসহ বিভিন্ন কাঁচামাল নৌকাতেই পচে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেছেন, অবরোধের শেষ দিন কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। নিরাপত্তা জোরদারে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন ছিল। শহরে চালু হয়েছে গণপরিবহন, খুলেছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় বাসিন্দা চৌধুরী হারুনুর রশীদ জানিয়েছেন, রাঙামাটিবাসী সব সময় শান্তিপ্রিয়, সবাই শান্তিতে থাকতে চাই। সকাল থেকে আমরা স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছি। কারও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
এদিকে রাঙামাটির বৌদ্ধবিহারে ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন ভিক্ষুরা। গতকাল সকালে শহরের বনরূপা এলাকার মৈত্রী বৌদ্ধবিহারে সংবাদ সম্মেলন থেকে এই দাবি জানায় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি শ্রদ্ধালঙ্কার মহাথের বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ কিছু লোক বিহারে প্রবেশ করে হামলা চালায়। তারা বিহারের পবিত্র বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুর করে এবং বিহারের থাকা দানবাক্স নিয়ে যায়।
সাজেকে আটকা দেড় হাজার পর্যটক:
অবরোধের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সাজেকে প্রায় দেড় হাজার পর্যটক ও ১৭৮টি পর্যটকবাহী গাড়ি আটকা পড়ে ছিল। সাজেকে বিদ্যুৎ সংযোগ গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রয়েছে। জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও অবরোধের কারণে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে অনেক কটেজে জেনারেটর সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেছে। আবার জ্বালানি তেল না থাকায় পানি সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গতকাল দুপুরে পর্যটক আল আমিন বলেছেন, এখানে খাবার ও পানির সংকট আমরা খুব কষ্টে আছি। যতদ্রুত সম্ভব আমরা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাড়ি যেতে চাই।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, সাজেকে আটকে পড়া পর্যটকদের বিভিন্ন সংকটের বিষয়টি আমরা জেনেছি। বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলছি।
জুম্ম ছাত্র-জনতার ৭ দফা:
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, অবরোধের শেষ দিন ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাত দফা দাবি জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষে অংকন চাকমার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের প্রতি এই সাত দফা তুলে ধরা হয়। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার পাহাড়ি অধিবাসীসহ তিন পার্বত্য জেলার জুম্ম জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হামলার তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া; নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা দেওয়া; ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহার পুনর্নির্মাণ, দোকানপাট ও বাড়িঘরের মালিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।