সমবায় ব্যাংক থেকে ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক নেতা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৪ মাসের মধ্যে ১৫০ কোটি টাকা দামের এসব স্বর্ণ গায়েব করেন তিনি। এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন তার ভাগনে ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ)। ২০২১ সালে ব্যাংকটির স্বর্ণ গায়েবের ঘটনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে আসে।
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগের ওই নেতা। এরপর ভল্টের দায়িত্ব দেন তার ভাগনে ও ব্যাংকটির এজিএম চাচাতো ভাইকে। এই দুজনের সহায়তায় ব্যাংক থেকে স্বর্ণ লুট করেন তিনি। পরে স্বর্ণ গায়েবের বিষয়টি সামনে চলে এলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত বন্ধ করে দেন। এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিকেও কাজ করতে দেননি তিনি।
পরে ২০২১ সালে ব্যাংকটির স্বর্ণ চুরির ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। এতে ১ নম্বর আসামি করা হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যানকে। পরে চার্জশিট থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের নাম কাটিয়ে নেন তিনি। কিন্তু ভাগনে ও ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) এবং চাচাতো ভাইকে বাঁচাতে পারেননি।
জানতে চাইলে সমবায় ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক ঝর্ণা প্রভা দেবী বলেন, এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তখন তিনি কোর্টে মামলা করে এই তদন্তের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করিয়েছিলেন। এই তদন্ত কমিটি শুধু স্বর্ণ জালিয়াতি নয়, অন্য আরও অনেক অনিয়ম নিয়ে কাজ করার জন্য গঠিত হয়েছিল।
দুদকের মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর সমবায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বর্ণ জালিয়াতি, ঘুষ-বাণিজ্য ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসে দুদকে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকেসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলা করেন সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে ওইদিনই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান জামিন নিলেও ফেঁসে যান দায়িত্বরত পাঁচ কর্মকর্তা।
সমবায় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ঋণের বিপরীতে ১৩ হাজার ২২৫ ভরি স্বর্ণ জামানত রেখেছিল নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে দীর্ঘ ১০ বছরেও সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বহুবার চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পরে সমবায় ব্যাংকের ৩০তম ব্যবস্থাপনা কমিটির ৫১তম সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের বিপরীতে রাখা স্বর্ণ বিক্রি করা হবে জানানো হয়। তা না হলে ব্যাংকের তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
সূত্র জানায়, গ্রাহক নিখোঁজের সুযোগ কাজে লাগায় ব্যাংকের একটি চক্র। গ্রাহকের পরিচয়পত্র নকল করে সমবায় ব্যাংকে আবেদন করার নাটক সাজায় চক্রটি। স্বর্ণ ফেরত পেতে এক হাজার ৯৮৪টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। কিন্তু এর বেশিরভাগই ছিল ভুয়া।
শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, ঢাকাতেও স্বর্ণ জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা অংশে ভুয়া স্বাক্ষর ও নকল পরিচয়পত্র দিয়ে মোট ৪৫৫টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ১২০ জন সঠিক গ্রাহককে স্বর্ণ ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৩৫টি আবেদন ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এভাবে ঢাকা থেকে মোট ৩৩৫ গ্রাহকের এক হাজার ৫৯৪ ভরি ১৪ আনা স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছে চেয়ারম্যান চক্র। গড়ে ১৮ ক্যারেট হিসাবে প্রতি ভরি ৫৪ হাজার ১৮০ টাকা ধরে মোট ৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।