সোমবার সব পাওনা পরিশোধের কথা ছিল। এর মধ্যে কর্তৃপক্ষ পাওনা টাকা তিন মাস পর পরিশোধ করা হবে বলে নোটিশ টানিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কীভাবে মালিকপক্ষ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়? গতকাল মঙ্গলবার এমন প্রশ্ন তোলেন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বার্ডস গ্রুপের পোশাক শ্রমিক মো. বাবু।
ক্ষোভ দেখিয়ে বাবু বলেন, আমাদের সার্ভিস বেনিফিট, ছুটির টাকা, অন্য কোনো বকেয়া থাকলে সেগুলো দেওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ করে রানিং ফ্যাক্টরি লে-অফের নোটিশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এক বছরের ওপরে যাদের চাকরির বয়স, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যাদের চাকরির বয়স এক বছরের কম তাদের কি কোনো ক্ষতি হয়নি।
শুধু বাবু নন, তার মতো অনেক পোশাক শ্রমিক নিহত ও বকেয়া বেতনের দাবিতে শিল্পাঞ্চলে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। বার্ডস গ্রুপের চারটি কারখানা বার্ডস আর এন আর ফ্যাশন্স লিমিটেড, বার্ডস গার্মেন্টস, বার্ডস ফেডরেক্স, বার্ডস এ অ্যান্ড জেড লিমিটেড পাওনাদি পরিশোধ না করে বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর এসব কারখানার প্রায় ২ হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক সোমবার সড়ক অবরোধ করেন, যা গতকাল মঙ্গলবারও চলে।
জানা গেছে, বার্ডস গ্রুপের কারখানাগুলো বাইপাইল বুড়ির বাজার এলাকায় অবস্থিত। এ কারখানাগুলো গত ২৮ আগস্ট থেকে লে-অফ ঘোষণা করে। শ্রমিকরা এতে রাজি না হলে পরে কারখানা ১২৪ (ক) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সোমবার শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের কথা ছিল। তবে শ্রমিকরা সকালে কারখানার সামনে এসে দেখেন, কারখানা ফটকে টাকা পরিশোধের সময়সীমা তিন মাস বৃদ্ধি-সংক্রান্ত নোটিশ লাগিয়ে রেখেছে মালিকপক্ষ। গত রোববার এ নোটিশ জারি করে বার্ডস গ্রুপ।
এদিকে দিনভর চলা বিক্ষোভে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট। ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে প্রায় ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেছেন শ্রমিকরা। গাজীপুরেও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। এ ছাড়া শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শিল্পাঞ্চল ঘুরে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় শ্রমিকদের সড়কে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা যায়। এতে সড়কের নবীনগর থেকে বাইপাইল হয়ে কবিরপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিমি যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্রামুখী সড়কে নবীনগর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত তিন কিমি ও ঢাকামুখী লেনে কবিরপুর থেকে বাইপাইল ১০ কিমি সড়কে যানজট দেখা দেয়। মহাসড়কের বাইপাইল পয়েন্টের উভয় লেনেই সোমবার সকাল ৮টা থেকে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন শ্রমিকরা। গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজেও সড়ক অবরোধ করে রেখেছিলেন তারা। অবরোধের কারণে নবীনগর ত্রিমোড় কেন্দ্র করে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশাপাশি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও জট সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আরিচামুখী সড়কে নবীনগর থেকে সাভারের দিকে প্রায় ১০ কিমি ও ঢাকামুখী সড়কে নবীনগর থেকে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় দুই কিমি যানজট সৃষ্টি হয়।
সাভার হাইওয়ে থানার ওসি আইয়ুব আলী বলেন, সোমবার থেকে বাইপাইলে একই অবস্থা। সড়কে যান চলাচল বন্ধ। কোনো বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। অ্যাকশনে গেলেও তো অন্য সমস্যা। আমরা কী করতে পারি?
এদিকে আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে এক শ্রমিক নিহতের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ১৫ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন তারা। এ সময় সড়কের উভয় লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি পরিষেবার যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা খুন হচ্ছেন, সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষোভের। সরকার যদি ভাবে তারা শ্রমিকদের দমিয়ে রাখবে, তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের কাফেলা গিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াবে এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে পাশে থাকবে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্কসবাদী) জাবি শাখার সংগঠক সজীব আহমেদ বলেন, আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শ্রমিকের টাকায় চলে, আমার শিক্ষকের বেতন হয় শ্রমিকের টাকায়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসবাব ক্রয় করা হয় শ্রমিকের টাকায়। যার কারণে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি শ্রমিকের কাছে দায়বদ্ধ। শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে।
অন্যদিকে, গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধের ১১ ঘণ্টা পর সড়ক থেকে সরে গেছেন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। মঙ্গলবার সকালে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার টি অ্যান্ড জেড গ্রুপের অ্যাপারেলস প্লাস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে শ্রমিকরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন না পরিশোধ করেই কারখানা বন্ধ করে দেয় টি অ্যান্ড জেড গ্রুপের অ্যাপারেলস প্লাস লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় সেপ্টেম্বরের শুরুতে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। মালিকপক্ষ ৩০ সেপ্টেম্বর পরিশোধের কথা জানায়। পূর্বনির্ধারিত সময়ের পর গত সোমবার বিকেলে বেতন চাইলে কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করেনি। পরে রাতেই শ্রমিকরা বিক্ষোভ এবং মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকার এম এম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা টিফিন বিল, নাইট বিল ও হাজিরা বোনাস বাড়ানোর দাবিতে সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করেন। কোনো সমাধান না হওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে ফের কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন তারা।
‘গুজব ছড়িয়ে সংঘর্ষের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে’: সাভারে শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনাটি মূলত গুজব ছড়িয়ে বাধানো হয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তৃতীয়পক্ষ প্রথমে গুলি ছুড়ে উসকানি দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, সাভারের সংঘর্ষের ঘটনাটি পেছনে ‘একজন নারীকে ধর্ষণ এবং দুজনকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছে’—এমন গুজব ছড়িয়ে শ্রমিকদের আনা হয়েছে। সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ওই পক্ষ থেকে গুলি ছুড়ে উসকানি দেওয়া হয়েছে। যার কারণে সংঘর্ষটি বাধে। আমরা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করেছি। তদন্ত হচ্ছে। তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, সে ঘটনায় একজন শ্রমিক নিহত, ১৩ জন পুলিশ সদস্যসহ অনেক শ্রমিক আহত হয়েছেন। আহত সবার আমরা চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছি। পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৩ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। এ সময় শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এ ঘটনার ক্ষেত্রে আপনারা একটু ফ্যাক্ট উপস্থাপন করবেন। আমরা শ্রমিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই না। প্রতিটি জায়গায় যেখানেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। মালিকদের থেকে কীভাবে বেতন আদায় করে দেওয়া যায়, সে কাজ করছে।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ২৪ তারিখ যৌথ বিবৃতিতে সবাই স্বাক্ষর করেছে। এটির যারা ব্যত্যয় করবেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। যেসব মালিক বেতন দিচ্ছেন না, আমরা এগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। আজকেও (গতকাল) খবর পেয়েছি, বাইপাইলে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন বকেয়া বেতনের দাবিতে। আমরা কারখানা মালিকদের খুঁজছি, তাদের ব্যাংকেও অনেক ঋণ। কিন্তু দুঃখজনক হলো তারা পলাতক। আমরা তাদের খুঁজে আইনের আওতায় আনব।