টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে একের পর এক ডুবছে পার্বত্য জেলার বিভিন্ন গ্রাম। ধস আতঙ্ক জেঁকে বসেছে পাহাড়ে। সড়ক ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দুর্গম এলাকা। এরই মধ্যে কক্সবাজারের এবং বান্দরবানে পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় মা-মেয়েসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম। বান্দরবান শহরের একমাত্র বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি প্লাবিত হওয়ায় গত রোববার থেকে বিদ্যুৎহীন পুরো জেলা। নেটওয়ার্ক না থাকায় মোবাইল ফোনের যোগাযোগও কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পাহাড় ধস হয়েছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার দুটি স্পটে। বাসিন্দারা কোনোরকমে রক্ষা পেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১০টি বাড়ি ও মালপত্র। এ ছাড়া মুহুরী নদী রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ফেনীর ফুলগাজীসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তলিয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ফসলি জমি ও মাছের ঘের। কালবেলার ব্যুরো অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
কক্সবাজার-বান্দরবানে পাহাড় ধসে ঝরল ৬ প্রাণ: গতকাল সোমবার কক্সবাজারের উখিয়া ও চকরিয়া এবং বান্দরবানের আলীকদমে পাহাড় ধসে মা-মেয়েসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন রোহিঙ্গা।
উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-৯) এবং উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক আমির জাফর বলেন, কয়েকদিন ধরে উখিয়ায় ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরে ধসে পড়ছে। সোমবার বিকেলে আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৯) এ/৬ ব্লকে পাহাড় ধসে রোহিঙ্গা আনোয়ার ইসলামের শেডে (ঘর) পড়ে। এতে তার স্ত্রী জান্নাত আরা ও মেয়ে মাহিম আক্তার মাটির নিচে চাপা পড়েন। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। পরে তাদের মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
একইদিন পাহাড় ধসে চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের সবুজপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় তাবাচ্ছুম ও সাবিদ নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক কাইছার হামিদ জানান, নাজিম উদ্দিনের বাড়িটি পাহাড়ের নিচেই। গতকাল বিকেলে বাড়িতে তার দুই শিশু ঘুমাচ্ছিল। নাজিম উদ্দিন ও তার স্ত্রী বাড়ির উঠানে কাজ করছিলেন। এ সময় পাহাড় ধসে পড়লে ওই দুই শিশু মাটির নিচে চাপা পড়ে। স্থানীয় লোকজন মাটি সরিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করেন।
এর আগে দুপুরে বান্দরবানের আলীকদমে পাহাড় থেকে মাটি কাটার সময় ভূমিধসে ছবি রহমান ও মোহাম্মদ মুসা নামে দুই রোহিঙ্গা শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
প্লাবিত পেকুয়ার দুই শতাধিক গ্রাম: বেড়িবাঁধ ভেঙে মাতামুহুরী নদীর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। চকরিয়া থেকে বাঘগুজারা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল ভোর থেকে এসব গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করে। তলিয়ে গেছে বীজতলা, চিংড়ি ঘের, সড়ক ও বিভিন্ন ঘর বাড়ি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন দেখা গেছে,
পহরচাঁদা-পেকুয়া সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরনামার বাঘগুজারা রাবার ড্যাম সংলগ্ন বেড়িবাঁধের দেড় চেইন পর্যন্ত ভেঙে গেছে। এতে করে পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, শিলখালী, বারবাকিয়া ও টৈটং ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
পেকুয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ জানান, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভাঙা অংশ মেরামত করা না হলে আরও ভয়াবহ হবে পেকুয়ার জন্য।
চকরিয়ার ভেসে গেছে চিংড়ি ঘের: কক্সবাজারের চকরিয়ার উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা পানিতে নিমজ্জিত। পানিতে ভেসে গেছে হাজারো একর চিংড়ি ঘেরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কোটি কোটি টাকার মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারো একর জমির ফসল ও বীজতলা। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী শাখা কর্মকর্তা জামাল মোর্শেদ বলেন, সোমবার সকাল থেকে বালির বস্তা দিয়ে পানি ঠেকানোর প্রচেষ্টা চলছে। ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে অবস্থা নাজুক হতে পারে।
রাঙামাটিতে ১৯৮ স্পটে ভাঙন: জেলার ১৯৮ স্পটে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কাপ্তাই হ্রদে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ এক কিশোর। ২৩৪টি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ হাজার ৭২৭ জন। বিভিন্ন সড়কের ৯টি স্পটে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যায় প্লাবিত হয় জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলার নিম্নাঞ্চল।
নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া বলেন, যেসব স্থানে ভাঙন দেখা গেছে, সেসব স্থানে আপাতত ভারী যানবাহন চলাচল বিরতি রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের মাইকিং প্রচার অব্যাহত রয়েছে। রাঙামাটি চট্টগ্রাম, রাঙামাটি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি বান্দরবান সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সড়ক বিভাগে চারটি টিম কাজ করছে।
বিচ্ছিন্ন বান্দরবান: বান্দরবানের সঙ্গে সড়কপথে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের একমাত্র বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি প্লাবিত হওয়ায় গতকাল থেকে পুরো জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় ফোন যোগাযোগও কার্যত অচল। শহরের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় গতকাল সকাল ১১টা পর্যন্ত আট হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাসলিমা সিদ্দিকা। তিনি জানান, জেলা শহরে বহু মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হচ্ছে।
মোংলা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত: মোংলা সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে। টানা বৃষ্টিপাত ও ঝোড়ো হাওয়ায় এলাকায় দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। বন্দর জেটিতে পণ্য ওঠানামার কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও বন্দর চ্যানেলে অবস্থানরত বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের পণ্য খালাস অনেকটাই বন্ধ। জোয়ার ও বৃষ্টিতে তলিয়েছে মোংলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু চিংড়ি ঘের।
পরশুরামে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত: উপজেলার মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ১২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম অলকা গ্রামে মুহুরি নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অজিত দেবনাথ বলেন, নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে সহযোগিতার জন্য প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
মিরসরাইয়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত: এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, মিরসরাই সদর, মিরসরাই পৌরসভা, বারইয়ারহাট পৌরসভা, খৈয়াছড়া, ওসমানপুর ও ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে। জোরারগঞ্জ-টেকেরহাট সড়ক, বারৈয়ারহাট-রামগড় সড়কে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে ফেনাপুনি, ওসমানপুরের মরগাং, ইছাখালীর চরশরৎ গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার। এ ছাড়া বড়তাকিয়া, মলিয়াইশসহ বিভিন্ন জায়গায় গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ধুনটে যমুনার তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন: বগুড়ার ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। অব্যাহতভাবে পানি কমতে থাকায় অতিরিক্ত স্রোতে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়ে ভাঙছে যমুনা নদীর ডান তীর রক্ষা প্রকল্পের বাঁধ। গতকাল সকাল থেকে উপজেলার ভাণ্ডারবাড়ি ইউনিয়নের পুকুরিয়া-ভূতবাড়ি এলাকায় নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার অংশ বিলীন হয়েছে। বর্ষার শুরুতেই ভয়াবহ ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ জনবসতি এলাকা।
বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী নিবারণ চক্রবর্তী জানান, খবর পেয়ে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পুরো ভাঙন এলাকা চিহ্নিত করে বালুভর্তি বস্তা ফেলে ও ব্লক বসিয়ে মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। গত রোববার থেকে টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে শহরের বিভিন্ন মহল্লার রাস্তাঘাট। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি রাস্তা উপচে বিভিন্ন দোকানপাট ও বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে শহরবাসী। স্থানীয়রা জানায়, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। শহরের অধিকাংশ ড্রেন ময়লায় আটকে আছে। দিনের পর দিন পাড় হলেও পৌর কর্তৃপক্ষ এসব ড্রেন পরিষ্কার করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও মহল্লার খাল ও নালা এবং পুকুর ভরাট করে ইমারত নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা।
পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আ. কুদ্দুস বলেন, ফুলবাড়িয়া এলাকায় একটি ক্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। সেটি দিয়ে টাউন খালে পানি নেমে যেত। ফোর লেন কাজে সম্পৃক্তরা সে ক্যানেল বন্ধ করে দিয়েছেন। জলাবদ্ধতা নিরসনে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে লোক পাঠানো হয়েছে। দ্রুতই পানি নেমে যাবে।
বরিশাল শহরে পানি, ভাসছে নিম্নাঞ্চল: টানা তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে বরিশালে। বিশেষ করে গত রোববার রাত থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে অতি ভারি বর্ষণে বিপর্যয় নেমে এসেছে জনজীবনে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বেশিরভাগ সড়ক। নদীতে জোয়ারের পানি বাড়ায় সড়কে জমে থাকা পানি নামতে পারছে না। ফলে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। সরেজমিন সোমবার বিকেলে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অতি ভারি বর্ষণের কারণে নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে কাকলীর মোড় থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে হাঁটুসমান জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া নগরীর নিম্নাঞ্চল পলাশপুর, রসুলপুরের অসংখ্য বাড়িঘর জোয়ার এবং বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে আছে। এ ছাড়া রূপাতলী, কাজিপাড়া, নবগ্রাম রোড, কালীবাড়ি রোড, বগুড়া রোড, বান্দ রোডের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনটি আবাসিক কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপাদা এবং বিআইপি কলোনি, পার্শ্ববর্তী বঙ্গবন্ধু কলোনিসহ অন্য এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসেন জানিয়েছেন, অতি ভারি বর্ষণের কারণে সর্বত্র পানি জমেছে। তা ছাড়া নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে স্থলভাগে জমে থাকা পানি নামতে পারছে না।
মন্তব্য করুন