অপরাধ তদন্ত ও কারাগারকে বিচার বিভাগের আওতায় নেওয়া, বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা না করা এবং স্থানীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার পরামর্শ দিয়েছেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তারা সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের সুযোগ রাখা এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করারও পরামর্শ দেন।
জাতীয় সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষে শুরুতেই পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংস্কার কমিশন। এতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কবি হাসান হাফিজ, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর পক্ষে সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সায়ীদ মেহবুব ইল কাদের, ডক্টরস প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলস হেলথ (ডিপিপিএইচ)-এর পক্ষে সহসভাপতি ডা. ফায়জুল হাকিম ও সদস্য ডা. মো. হারুন অর রশিদ অংশ নেন। এরপর সংবিধান
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে কমিশন। এ পর্যায়ে বিচারপতি এম এ মতিন, অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, অধ্যাপক কে এম শামসুদ্দিন মাহমুদ ও আইন কমিশনের উপদেষ্টা এ কে মোহাম্মদ হোসেন অংশ নেন। অন্যদিকে সংস্কার কমিশনের পক্ষে কমিশন প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অধ্যাপক মো. ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মো. মুসতাইন বিল্লাহ সভাগুলোয় উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্র জানায়, মতবিনিময়কালে পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক নিশ্চিতের পরামর্শ দেন। বিশেষ করে জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করে রাষ্ট্রকে জনগণের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার কথা সংবিধানে উল্লেখ করতে বলেন। নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, অর্থনৈতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার পরামর্শও দেন তারা। অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার কথা বলেন। এ ছাড়া আসামিদের অপরাধের বিষয়টির তদন্ত এবং কারাগারকেও বিচার বিভাগের অধীনে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তারা। তারা বিদ্যমান সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ সংশোধন ও বাতিলের কথাও বলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বিচারপতি এম এ মতিন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের পরামর্শ দেন। এ ছাড়া সংসদে এমপিদের ‘ফ্লোর ক্রসিং’য়ের সুযোগ রাখার পরামর্শ দেন তিনি। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার কথা বলেন। বিদ্যমান সংবিধানে যেসব ইতিবাচক বিষয় রয়েছে সেগুলো বহাল রাখার কথাও বলেন এই বিচারপতি।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
সূত্র জানায়, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর পক্ষ থেকে সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সায়ীদ মেহবুব ইল কাদের বিদ্যমান সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের ৬-এর ২ অনুচ্ছেদে জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি রয়েছে। সেখানে জাতি ও নাগরিক উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশি করতে হবে। ৭ এর ক এবং খ অনুচ্ছেদ রহিত করার দাবি জানান তিনি। তিনি ১৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য বলেন। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের পরামর্শও দেন এই পেশাজীবী নেতা। তিনি বলেন, ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগ স্বাধীনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে তা নেই। এটি নিশ্চিত করতে হবে।
বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে দেশের জনগণের মর্যাদা এবং স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করা যাবে না। ৩৩-এর ৪ অনুচ্ছেদে থাকা ‘বিবর্তন মূলক’ আইন বাতিলের কথা বলেন তিনি। ৪৬ অনুচ্ছেদে থাকা দায়মুক্তির বিধানও সংশোধন করতে বলেন তিনি। এ ছাড়া একই ব্যক্তি যাতে পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে না পারে, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বহাল, বিচারপতিদের অপসারণের পর আর কোথাও যেন পদায়ন না হয়, অর্থনৈতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার পরামর্শ দেন তিনি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের একটি চ্যাপ্টার রয়েছে। সেখানে ১৮টি মৌলিক অধিকারের জন্য আবার ১৫টি শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব মৌলিক অধিকারকে শর্তমুক্ত করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে সঠিকভাবে যুক্ত করতে হবে। নাগরিক অধিকার রক্ষায় জোর দিয়ে প্রতিটি জেলায় নাগরিক অধিকার আদালত গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের পাশাপাশি অপরাধ তদন্ত এবং কারাগারকে পুলিশের কাছ থেকে সরিয়ে বিচার বিভাগের ওপর নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠে। আসামিদের অপরাধের বিষয়টি বিচার বিভাগ তদন্ত করতে হবে। এরপর যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের জেলে যেতে হবে। তবে সেই জেল বা কারাগারকেও বিচার বিভাগের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।
বিদ্যমান সংবিধানে ১৫২ অনুচ্ছেদে থাকা রাষ্ট্র ও সরকার একই আছে। সে জন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথাও বলেন তিনি।
সংবিধান পুনর্লিখনের পরামর্শ দিয়ে ডক্টরস প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলস হেলথের (ডিপিপিএইচ) সহসভাপতি ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান বিদ্যমান সংবিধানকে নাকচ করে দিয়েছে। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বিপ্লব ও নতুন বাংলাদেশকে ধারণ করতে হলে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। কিন্তু সংস্কার কমিশন বিদ্যমান সংবিধানকে সংস্কারেই কাজ করছে। এটি ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধান পাকিস্তানি আমলের। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন ছিল এবং সেখানে সংবিধান পাস করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটাও করা হয়নি। এ সংবিধান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনগণকে দাসত্বে পরিণত করেছে।
পেশাজীবী নেতা আরও বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জনগণের জন্য চিকিৎসাকে আইন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়নি। জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়নি। রাষ্ট্রকে জনগণের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে হবে। এটি নতুন সংবিধানে উল্লেখ করতে হবে।
মতবিনিময় সভার বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সায়ীদ মেহবুব ইল কাদের কালবেলাকে বলেন, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিদ্যমান সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেছি। বিশেষ করে সংবিধানের ৬ এর ২ অনুচ্ছেদ, ৭ এর ক এবং খ, ১৮ অনুচ্ছেদ, ২২ অনুচ্ছেদ, ৩৩ এর ৪, এবং ৪৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেছি। সংবিধানে থাকা দায়মুক্তির বিধান নিয়েও পরামর্শ দিয়েছি। এ ছাড়া একই ব্যক্তি যাতে পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে না পারে, নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বহাল, বিচারপতিদের অপসারণের পর আর কোথাও যেন পদায়ন না হয়, অর্থনৈতিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা হ্রাস করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম কালবেলাকে বলেন, মৌলিক অধিকার এবং অধিকার রক্ষায় নাগরিক প্রতিটি জেলায় নাগরিক অধিকার আদালত গঠনের পরামর্শ দিয়েছি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের পাশাপাশি অপরাধ তদন্ত এবং কারাগারকে পুলিশের কাছ থেকে সরিয়ে বিচার বিভাগের কাছে নেওয়ার কথা বলেছি। এ ছাড়া রাষ্ট্র ও সরকারকে আলাদা করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের পরামর্শ দিয়েছি।