

স্বাস্থ্যকর ও ক্যাফেইনমুক্ত পানীয় হিসেবে রোজেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাড়ির সামান্য পতিত জমিতে খুব সহজেই রোজেল চাষ করে পরিবারের জন্য সারা বছরের পানীয়, আচার, জেলি বা জ্যাম তৈরি করা সম্ভব। রোজেলের এমন সম্ভাবনাই তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকদল।
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে রোজেল উদ্ভিদের পাতা ও বৃতির পুষ্টিগুণ, খাদ্যমান ও বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে গবেষণার ফল তুলে ধরেন ‘রোজেল উদ্ভিদের পাতা ও বৃতি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কলাকৌশল’ প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান প্রামাণিক, অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান, অধ্যাপক ড. আ. খ. ম. গোলাম সারওয়ার, অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. শাহানারা বেগম ও অধ্যাপক ড. মো. নেছার উদ্দীন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন গবেষণা সহযোগী ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী স্বাগত ইসলাম স্বর্ণা ও আফিয়া মারিয়াম।
প্রধান গবেষক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির বলেন, রোজেল উদ্ভিদের পাতা ও বৃতিতে রয়েছে পুষ্টি, খাদ্য ও ঔষধিগুণের অনন্য সমন্বয়। ফুলের স্থায়ী ও মাংসল বৃতি থেকেই তৈরি হয় জ্যাম, জেলি, চা, আচার, চাটনি ও নানা ধরনের পানীয়। বর্তমানে এ পানীয় নিয়েই আমরা গবেষণা করেছি। রোজেলের পানীয় চা-কফির ভালো সমাধান। চা-কফিতে থাকা ক্যাফেইন বেশি গ্রহণ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সেখানে রোজেল পানীয়তে ভরপুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
তিনি আরও বলেন, লালচে রঙের বৃতিই রোজেলের প্রধান ফলন। এ বৃতির প্রতি গ্রাম শুকনা অংশে প্রায় ১ দশমিক ৬০ থেকে ১ দশমিক ৮৬ গ্রাম অ্যান্থোসায়ানিন (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট) পাওয়া যায়। পাশাপাশি এতে রয়েছে ফ্ল্যাভনয়েড, ক্যারোটিন, প্রোটিন, চর্বি, ফাইবার ও প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা অসুস্থতার উপশমে রোজেল কার্যকর।
প্রধান গবেষক বলেন, রোজেল বৃতিতে প্রতি লিটারে ৩ থেকে ৪ গ্রাম অরগানিক অ্যাসিড থাকে। এ কারণেই এটি টক স্বাদ দেয়। শুকনা পাতা ও বৃতিতে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া সহজে জন্মে না। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি একটি বাড়তি সুবিধা।
অন্যান্য ফল ও সবজির সঙ্গে রোজেলের তুলনা করে তিনি বলেন, অন্যান্য ফল ও সবজিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অন্যান্য মৌলের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় থাকলেও রোজেলে থাকে মুক্ত অবস্থায়। তাই রোজেলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারিতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এটির কচি পাতা ও ডগা টক স্বাদের হওয়ায় এগুলো ডাল বা তরকারিতে রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। পাহাড়ি অঞ্চলসহ দেশে বহু এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোজেল পাতার ব্যবহার রয়েছে। পার্বত্য জেলায় ‘অ্যামলিয়া’ শাক নামে এটি বাজারেও বিক্রি হয়। বর্তমানে
ছোলায়মান আলী ফকির বলেন, বৃতির পাশাপাশি এর পাতা৷ নিয়েও গবেষণা শুরু হয়েছে। রোজেলের পাতা রোদে মাত্র দুই থেকে তিন দিন শুকিয়ে গুড়া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা যায়। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই রোজেল পাতা রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে রোজেল পাতার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশেও এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
চাষাবাদ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, বিশ্বের গ্রীষ্ম ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রোজেলকে একটি শিল্প উদ্ভিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বীজ বপনের প্রায় ২২০ দিন পর প্রতিটি গাছে গড়ে ১৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম বৃতির ফলন পাওয়া যায়। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৩ থেকে ৭ টন পর্যন্ত হতে পারে। বৃতির উজ্জ্বল লাল রং খাদ্যে প্রাকৃতিক রং হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি কাণ্ড ও শাখা থেকে পাটজাতীয় আঁশ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে।
গাছটির আরও নানা ব্যবহার তুলে ধরে প্রধান গবেষক বলেন, পরিপক্ব বীজে প্রায় ২০ শতাংশ আমিষ ও ২০ শতাংশ চর্বি থাকে। এটি প্রক্রিয়াজাত করে পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। ফসল খেতের বেড়া হিসেবেও রোজেল খুব কার্যকর। আবার গাছ কাটার পর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এর সবুজ বা লালচে গাছ শোভাবর্ধক হিসেবেও দৃষ্টিনন্দন।
ছোলায়মান আলী ফকির বলেন, স্বল্প খরচে চাষ ও সহজ প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণে রোজেলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক। বাড়ির পাশে রৌদ্রযুক্ত জায়গায় মাত্র চার বা পাঁচটি রোজেল গাছ থাকলেই একটি পরিবারের জন্য সারা বছরের চা, জ্যাম, জুস বা আচার তৈরি করে নেওয়া সম্ভব।
মন্তব্য করুন