রাফসান জানি
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৫ এএম
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হত্যার পরও কেন নৃশংসতা

পরিচয় আড়াল করার চেষ্টা
হত্যার পরও কেন নৃশংসতা

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গত ১৫ দিনে অন্তত চারটি নৃশংস হত্যা হয়েছে। হত্যার পর লাশ কখনো খণ্ড খণ্ড করে ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে ফেলা হয়েছে, কোনো ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে ডিপ ফ্রিজে, আবার কোনো হত্যাকারী পুঁতে রেখেছে মাটির নিচে।

ঢাকা, সাভার, বগুড়া ও সিলেটের পৃথক চারটি ঘটনায় দেখা গেছে, মৃত্যু নিশ্চিত করার পর খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে বা পুঁতে রাখা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জড়িতরা নিজেদের পরিচয় আড়াল করতে মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করছে এবং বিভিন্ন জায়গায় ফেলছে, যাতে সহজে মরদেহ খুঁজে না পাওয়া যায় এবং জড়িতদের যেন শনাক্ত করা না যায়।

তবে তাতে তারা পার পাচ্ছে না কেউ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নিবিড় তদন্তে বেরিয়ে আসছে জড়িতদের নাম, গ্রেপ্তার হচ্ছে হত্যাকারীরা। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, চৌকস তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতায় আসামিরা ধরা পড়ছে।

সবশেষ ১০ নভেম্বর নৃশংস হত্যার শিকার হন শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম। রাজধানীর একটি বাসায় তাকে হত্যার পর টয়লেটে বসে কেটে টুকরা টুকরা করা হয়। এরপর দুই দফায় সেগুলো প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপশহরে ফেলা হয়। কাজটি করেন রুমা আক্তার নামে এক নারী, যার সঙ্গে জসিমের বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রুমা জানিয়েছে, চাপাতি দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার পর টয়লেটে নিয়ে টুকরা টুকরা করা হয় জসিমের দেহ। কাজটি তিনি একাই করেছেন। চাপাতি দিয়ে কাটলে শব্দ বাইরে যাবে, হ্যাকসো ব্লেড দিয়ে কেটে টুকরা করেন তিনি। টুকরাগুলো ময়লার পলিথিনে ভরে ডিপ ফ্রিজে রাখেন। পরে দুই দফায় তিনি সেগুলো ফেলে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, একেকটি হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট একেক রকম। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পারিবারিকসহ বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হচ্ছে। মৃতদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করার পেছনে দুটি কারণ কাজ করে। প্রথমত, যাতে করে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করা না যায় এবং কোনোভাবে যেন খুঁজে না পাওয়া যায়। গত ৩ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের পাঁচ বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন প্রতিবেশী শামীমা বেগম মারজিয়া। হত্যার পর লাশ গুম করতে পুঁতে রাখা হয় বাড়ির পাশের একটি ডোবায়। শামীমাকে গ্রেপ্তারের পর সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, মুনতাহা হত্যার ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যে তিন নারী ও একজন পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে শামীমা হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। প্রাইভেট না পড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। অন্য কারণও থাকতে পারে, সেটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। হত্যাকাণ্ডে আরও কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তদন্তে তা বের হয়ে আসবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ বছরের মুনতাহাকে হত্যার পর লাশ গুম করতে ডোবায় পুঁতে রেখেছিল ঘাতকরা। তাদের ধারণা ছিল, লাশ খুঁজে না পেলে তারা সন্দেহের বাইরে থাকবে এবং গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা ফাঁদ পেতে লাশটি উদ্ধার করেছি। জড়িতদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত ১০ নভেম্বর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় নিজ বাসায় হত্যার শিকার হন উম্মে সালমা। হত্যার পর তার মরদেহ কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে চলে যায় খুনি। প্রথমে খুনি সন্দেহে নিহতের সন্তানকে র্যাব গ্রেপ্তার করলেও থানা পুলিশ তদন্ত করে জানিয়েছে, ভাড়াটিয়ারা হত্যা করেছে সালমাকে। এ ঘটনায় বাসার চারতলার ভাড়াটিয়া উপজেলার চামরুল ইউনিয়নের উত্তর সাজাপুর গ্রামের আইয়ুব আলীর স্ত্রী মাবিয়া বেগম (৫০), তার সহযোগী গুনাহার ইউনিয়নের তালুচ পশ্চিম পাড়ার আব্দুর রহিমের ছেলে মোসলেম উদ্দিন (২৬) ও একই এলাকার নিখিল রবিদাসের ছেলে ভ্যানচালক সুমন রবিদাসকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত ১১ নভেম্বর সাভারের বিরুলিয়ার দত্তপাড়া এলাকার একটি নার্সারি থেকে এক নারীর খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অদূরে ফেলে রাখা হয়েছিল মাথা ও দুই হাত। নিহতের নাম শান্তনা বেগম। তাকে হত্যার অভিযোগে স্বামী নয়ন মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির কালবেলাকে বলেন, হত্যার পর লাশের পরিচয় যাতে পাওয়া না যায়, সেজন্য মাথা ও হাত কেটে আলাদা করা হয়েছিল। পুলিশ দীর্ঘ সময় নিয়ে আশপাশ খুঁজে মাথা ও হাত পেয়েছে। নিহতের স্বামী নয়নকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের সন্দেহ ও পারিবারিক কলহের জেরে শান্তনাকে হত্যা করা হয়।

শাহীনুর কবির বলেন, এর আগে লাভলী আক্তার নামে আরেক নারীকে এভাবে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা মনে করে, মাথা, হাত-পা কেটে অন্যত্র ফেলে দিলে কেউ খণ্ডগুলো এক করে নিহতের পরিচয় বের করতে পারবে না। পরিচয় বের না হলে হত্যাকারী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। এই ভাবনা থেকে টুকরা টুকরা করে ফেলে দিলেও পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো উদ্ধার ও পরিচয় বের করছে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করছে জড়িতদের।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের তদন্ত আগের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়েছে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেও পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম। ফলে অপরাধীরা যত কৌশলই অবলম্বন করুক, তারা ছাড়া পাবে না।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, কারও প্রতি রাগ, ক্ষোভ থাকতে পারে। একেবারে মেরে ফেলার চিন্তাটা হত্যাকারীর সামনে আসে মূলত কয়েকটি কারণ থেকে। একটি হলো মেরে ফেললে কিছু হবে না। আবার হত্যাকারী নিজেকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে—এ রকম একটা ধারণা থেকেও হত্যার চিন্তা আসে। কিছু ক্ষেত্রে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলেও হত্যাকাণ্ড ঘটে।

তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থার সদস্যরা যদি সময় নিয়ে এই মামলাগুলো তদন্ত করে জড়িতদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে যথার্থ বিচার নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে সমাজে উদাহরণ তৈরি হয়। অপরাধী যত কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরতে পারে—এ ধারণাটা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই এ ধরনের নৃশংস হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘বিএনপি ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না’

এক ইলিশ ১০ হাজার টাকা

ভাতের হোটেলের পাওনা চাওয়ায় গুলি

ব্যক্তি স্বার্থে দলকে ব্যবহার করা যাবে না : সেলিমুজ্জামান

‘জনগণের অধিকার ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বিএনপি’

নিউইয়র্কের প্রবাসীদের এনআইডি কার্যক্রমের উদ্বোধন

কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

ফের জামায়াতের সমালোচনা করলেন হেফাজত আমির

জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতা হাসিবুলের প্রথম জানাজা সম্পন্ন

গণতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বের সমর্থন পাওয়া গেছে : মির্জা ফখরুল

১০

আমরা পা ছেড়ে মাথার রগে ফোকাস করছি, মজার ছলে সর্ব মিত্র

১১

নাটকীয় ম্যাচ জিতে টাইগারদের সিরিজ জয়

১২

জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যুতে হাসপাতালে ভিপি সাদিক কায়েম

১৩

হঠাৎ খিঁচুনিতে জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যু

১৪

আবারও ইনজুরিতে ইয়ামাল

১৫

ঈদগাহের নামকরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ

১৬

খুলনায় ছেলের হাতে বাবা খুন

১৭

চাকসু নির্বাচন / ১৫ সেকেন্ডে দিতে হবে ১ ভোট

১৮

‘ভোটের অধিকার না থাকায় শ্রমজীবীরা বেশি অমর্যাদার শিকার’

১৯

এক গ্রামে ১১ জনের শরীরে মিলল অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ

২০
X