বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কয়েকটি মেগা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয় করেছেন শতকোটি টাকা। বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও সাতটি বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঠিকাদারের সঙ্গে ‘পার্সেন্টেজ’ নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখেন। এরকম বেশকিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ রোববার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সংস্থাটির উপপরিচালক ও অভিযোগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. নাজমুল হাসান। একই সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় রেকর্ডপত্র চেয়েছেন।
এদিকে প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়ে দুদকের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি লিখেছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। চিঠির জবাবে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন জানান, তার বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
দুদক থেকে পাওয়া হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগমতে, বেচিচকে যতগুলো মেগা প্রকল্প রয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই অর্থ-বাণিজ্য করেছেন তিনি। অনিয়ম হালাল করতে তিনি রাতারাতি টেন্ডারের নিয়ম পাল্টে ফেলেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজে পিডি থাকার সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। পরে তাকে পিডির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সিভিল সার্কেল-১-এর দায়িত্বে থাকাকালে দুর্নীতি ও খামখেয়ালিপনার প্রমাণ পাওয়ায় হাবিবুর রহমানকে বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে অদৃশ্য কারণে তাকে একের পর এক মেগা প্রকল্পে পিডির দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে খুলনার খানজাহান আলী বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ ও নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ এবং প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান টার্মিনাল সম্প্রসারণ-নবরূপায়ণ এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজ। এসব প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ‘পার্সেন্টেজ’ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বেবিচক সদর দপ্তর ভবন নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ছিলেন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। বিভিন্ন কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে তিনি অহেতুক বিলম্ব করতেন। ঠিকাদারের সঙ্গে দেনদরবারের মাধ্যমে ‘পার্সেন্টেজ’ আদায় করে তারপর সিদ্ধান্ত দিতেন তিনি। ফলে ২৪ মাস মেয়াদের কাজ শেষ হয়নি ৭২ মাসেও। তার দুর্নীতির কারণে ভবনের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভবনের জন্য ফার্নিচার ক্রয়ের কাজও বিলম্বিত হচ্ছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের উন্নয়ন কাজ করার সময় সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অমান্য করেন তিনি। মেনে চলেননি সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের কোনো ধারা। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজে করোনার অজুহাত দেখিয়ে দরদাতার দাখিলকৃত দলিলপত্র সঠিক কি না, সেটা যাচাই-বাছাই না করেই দরপত্র চূড়ান্ত করেন হাবিবুর রহমান। ঠিকাদারের টার্নওভার সংক্রান্ত ব্যাংক নথি যাচাই করেননি। টেন্ডার ডকুমেন্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অভিজ্ঞতা সনদ, টেন্ডারারস কান্ট্রি অব অরিজিনে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস কর্তৃক ‘অথেনটিকেট’ করে নিয়ে দরপত্র দাখিল করার কথা। কিন্তু ওই ঠিকাদার বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো দলিলপত্র দেননি।
গড় বার্ষিক কনস্ট্রাকশন টার্নওভার-সংক্রান্ত শর্ত নিয়েও অনিয়ম করেছেন। এর পরও শর্তপূরণ না করা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন হাবিবুর। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পে ৮টি দরপত্র দাখিল হয়। সেখানে ৩টি প্রতিষ্ঠান সব নথি যথাযথভাবে দাখিল করলেও তাদের মধ্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ দেখিয়ে বাকি দুটিকে নন-রেসপন্সিভ করা হয়। যে কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করা হয়েছে তার জয়েন্ট ভেঞ্চারেও রয়েছে অনিয়ম। ওই জয়েন্ট ভেঞ্চারের একটি কোম্পানিকে ২০১৯ সালে কালো তালিকাভুক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিষয়টি নিয়ে হাবিবুর রহমানকে অন্য ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তার পছন্দের ওই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে আইএমইডির ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশন তদন্তে অনিয়ম এবং জালিয়াতির সত্যতা মেলে। আইএমইডির প্রতিবেদন দাখিলের পর বিষয়টি সেখানেই থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু হাবিবুর রহমান চতুরতার সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে আইএমইডির প্রতিবেদনকে পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে টেন্ডার অনুমোদনের জন্য পাঠান মন্ত্রিপরিষদ-সংক্রান্ত ক্রয় কমিটিতে। ক্রয় কমিটির সভায় অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ায় ওই দরপত্র বাতিল করে নতুনভাবে দরপত্র করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
শুধু কক্সবাজারেই নয়, সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্পে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্সিভ করা হয়। তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার নথিতে ভুল থাকার পরও রেসপন্সিভ করা হয়। বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছেন প্রকৌশলী হাবিব। যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজেও ধরা পড়েছে হাবিবুরের নজিরবিহীন দুর্নীতি। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্প কেটে তিন ভাগ করেন। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিলেও দুটি বিমানবন্দর প্রকল্পের কাজ করছে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় থমকে যায় যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজও।
এভাবে বিভিন্ন কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন হাবিবুর রহমান। তিনি গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে বিপুল সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। ঢাকায় বাড়ি ও প্লট কিনেছেন। নামে-বেনামে ব্যাংকে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ টাকা।
বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা ও দুদক হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগেও একাধিকবার তদন্ত করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি পার পেয়ে যান। আবার অনুসন্ধান চলছে। বিগত সরকারের সময় ভালো পোস্টিংয়ে ছিলেন। তার কারণে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ে এবং উন্নয়নের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। নানা অনিয়মের কারণে তাকে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে। দুর্নীতির কারণে তাকে ডিভিশন সিভিল সার্কেল-৩ থেকে প্রত্যাহার করে বেবিচকের ফ্লাইট সেফটিতে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে দুদকের একজন পরিচালক বলেন, আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তার বক্তব্য জানতে চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তার বক্তব্য গ্রহণের পর মামলার সুপারিশসহ কমিশনে দাখিল করা হবে।
দুদকের তদন্তের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।