ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষা এনএস-১ আইসিটি। ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল (ফলস নেগেটিভ) হয়ে থাকে। সম্প্রতি দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হলো ৪০৫ জনের, যা ২৪ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার ক্ষেত্রে এনএস-১ আইসিটি কম সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির এনএস-১ নেগেটিভ হলে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে রোগীকে এনএস-১ এলাইজা বা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগ পরিচালিত গবেষণাটি করা হয়েছে ২০০ নমুনার ওপর। যারা ডেঙ্গু হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে এসেছেন, নমুনাগুলো নেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে। দৈবচয়নের মাধ্যমে নেওয়া নমুনাগুলোর প্রথমে এনএস-১ আইসিটি, তারপর এনএস-১ এলাইজা এবং শেষে আরটি-পিসির পরীক্ষা করা হয়েছে। তুলনামূলক পরীক্ষায় দেখা গেছে, এনএস-১ আইসিটি পরীক্ষায় ৬৪টি রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আর আরটি পিসিআরে নেগেটিভ এসেছে আটটিতে। সংবেদনশীলতা পরীক্ষায় দেখা গেছে, এনএস-১ এলাইজা পরীক্ষার সংবেদনশীলতা আরটি পিসিআর ও এনএস-১ আইসিটির মধ্যবর্তী অবস্থানে।
ইতঃপূর্বে ব্রাজিলে, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পৃথক চারটি গবেষণায় অনুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এই চার গবেষণায় এনএস-১ আইসিটি পরীক্ষার সংবেদনশীলতার হার যথাক্রমে ৩৭ দশমিক ৭, ৪০ দশমিক ২, ৩৮ দশমিক ৫ এবং ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। সেখানে এই গবেষণায় সংবেদনশীলতার হার ৫১ শতাংশ।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরির মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ও এই গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ডা. আরিফা আকরাম বলেন, ডেঙ্গু শনাক্তের ক্ষেত্রে এনএস-১ আইসিটি পরীক্ষার ফল যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়, তা এসব গবেষণার ফল থেকেই প্রতীয়মান হয়। এ ক্ষেত্রে আরটি পিসিআর পরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি এনএস-১ এলাইজা পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন।
গবেষণায় ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর শীর্ষ মৌসুমে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) সন্দেহভাজন ডেঙ্গু রোগীদের নমুনা (সিরাম) সংগ্রহ করে ভাইরোলজি বিভাগ। সেখানে দেখা গেছে, ডেঙ্গু দ্রুত শনাক্তকরণে এনএস-১ এলাইজা পদ্ধতিটি ৯৪ শতাংশ কার্যকর। যেখানে এনএস-১ আইসিটি পদ্ধতিটি সর্বোচ্চ ৫৬ ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর পাওয়া গেছে। এতে আরও দেখা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর বাংলাদেশে এই চার বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। বিগত সময়ে ডেন-২-এর সংক্রমণ বেশি ছিল। গবেষণার ২০০ নমুনার মধ্যে ৯৬টি ডেন-২, ৩০ ডেন-৩ পাওয়া গেছে।
একটি এনএস-১ আইসিটি পরীক্ষায় ব্যয় হয় ২৫০ টাকা। এনএস-১ এলাইজা পরীক্ষা করতে লাগে ৪০০ এবং আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য খরচ হয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
গবেষকদের মতে, ডেঙ্গু পরীক্ষার ক্ষেত্রে এনএস-১ আইসিটি যেহেতু ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট দেয় এবং আরটি-পিসিআর ব্যয়বহুল। তাই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিশ্চিতে এলাইজা পরীক্ষা সহজলভ্য করা যেতে পারে। তা ছাড়া কভিড মহামারির সময়ে দেশের অনেক স্থানে পিসিআর যন্ত্র স্থাপন করা হয়। সেখানে ডেঙ্গু পিসিআর কিট সরবরাহ করা হলে পিসিআর করেও ডেঙ্গু নির্ণয় সম্ভব। গবেষকরা সেই রোগীদের জন্য একটি নতুন ডেঙ্গু পরীক্ষার কাঠামো প্রস্তাব করেন, যাদের ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও এনএস-১ আইসিটি পরীক্ষার ফল ফলস নেগেটিভ পাওয়া যায়।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫০০ ছাড়াল: ডেঙ্গু জ্বরে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে মৃত্যু হলো ৫০৪ রোগীর। দেশে এক বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর এই সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালে ১ হাজার ৭০৫ জন এই রোগে প্রাণ হারান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৃত সাতজনের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং খুলনা বিভাগীয় এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন করে মোট ছয় এবং বরিশাল বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬২৯ জন। এতে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৬৮৫ জনে। মঙ্গলবার পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯০ হাজার ৬২২ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ২ হাজার ৫৫৯ জন। এ বছর মোট ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৬ হাজার ২৫০ জন ঢাকার বাইরের। ঢাকার দুই মহানগর এলাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭ হাজার ৪৩৫ জন। এ বছর সবচেয়ে বেশি ৩০ হাজার ৮৭৯ রোগী ভর্তি হয়েছেন অক্টোবরে। অন্যদিকে এক মাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় নভেম্বরে, ১৭৩ জন। ডিসেম্বরের প্রথম তিন দিনে ২ হাজার ২১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের।