ঢাকার অদূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সাভারের আমিনবাজার ও বলিয়ারপুরের মধ্যবর্তী স্থানের নিষিদ্ধ মধুমতি মডেল টাউন (পরিবর্তিত নাম নান্দনিক হাউজিং)। সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এখনো প্রকাশ্যে চলছে এ হাউজিংয়ের কার্যক্রম। আর সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় ভাকুর্তা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি আব্দুল বাতেন। তার ইশারাতেই নানা অপরাধের ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে এ হাউজিং ঘিরে। অবৈধ জলাশয় ভরাট, মাদক সিন্ডিকেট, রিসোর্টের আড়ালে অসামাজিক কার্যকলাপ, দখল ও চাঁদাবাজি চলছেই। এতে অতিষ্ঠ এ হাউজিং এলাকার বাসিন্দারা। বাতেনের সহযোগী হিসেবে আছেন মো. বাদল নামে আরেক ব্যক্তি। একসময় হাউজিংয়ের কেয়ারটেকার পদে চাকরি নেওয়া বাদল হাউজিং ঘিরে অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলা বাতেনের ডান হাত।
সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ অবৈধ মডেল টাউনটি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর একটি উকিল নোটিশ পাঠায়। ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের মধুমতি টাউন আবাসিক প্রকল্প এলাকায় অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ কার্যক্রম গ্রহণ বিষয়ে একটি সভা আহ্বান করা হয়। গত বুধবার রাজউকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। এতে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বেলার প্রতিনিধিরা।
সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজউক কর্তৃক আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্পটির উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে। রাজউকের সঙ্গে সমন্বয় করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ওই এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করবে এবং ভবিষ্যতে রাজউকের অনুমোদন ছাড়া কোনো স্থাপনায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে না। জেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে জানানো হয়, বর্তমানে এ মৌজায় সব ধরনের নামজারি ও খাজনা আদায় বন্ধ আছে।
কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল বন্যা প্রবাহিত এলাকায় অবস্থিত এই মডেল টাউন রক্ষায় মাঠে নেমেছে। গতকাল শনিবার মধুমতি মডেল টাউন উচ্ছেদের প্রতিবাদে স্থানীয়দের নিয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ওই মহলটি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমিনবাজারের মধুমতি মডেল টাউনের সামনে ঢাকা আরিচা মহাসড়কে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
মানববন্ধনে বলা হয়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্লট মালিক মধুমতি মডেল টাউনে প্লট কিনে ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন। এখানে এক হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করছে। তারা বলছেন, সম্প্রতি বেলা এবং রাজউক কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই এখানকার হাজার হাজার মানুষকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের গৃহহীন করার পাঁয়তারা করছে। এ সময় উচ্ছেদের নির্দেশনা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তারা।
অবৈধ মধুমতি মডেল টাউন নতুন নাম দিয়ে কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের কথা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে। তার প্রতিষ্ঠান বেলা এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট মামলাটি করেছিল। রিজওয়ানা কালবেলাকে বলেছেন, মধুমতি অবৈধ। নান্দনিক হোক বা দৃষ্টি নন্দন হোক, এটিকে বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিতে হবে, যে কয়টা ভবন হয়েছে, বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে হবে।
তিনি বলেন, মাঝখানে রাজউক মডেল টাউন কর্তৃপক্ষকে বলেছিল মাটি সরিয়ে নিতে। তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। গত রেজিমে (আওয়ামী শাসন) এগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ খুব কম ছিল। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আমার জানা মতে সৎ নেতৃত্ব সেভাবে পায়নি। এ সময়ে জলাশয় রক্ষায় আমাদের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যদি আপনি আবার জিজ্ঞেস করেন, মাটি সরানো সম্ভব কি না, আমি বলব খাল খনন কি সম্ভব? খাল খনন যদি সম্ভব হয়, তাহলে ওখানে খাল খনন করতে হবে। সেটি না করতে পারার কোনো কারণ নেই। আমি আশা করি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা নেবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, আমাদের তো মধুমতির ব্যাপারে ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। মধুমতির রায়কে ভিন্নপথে চালিত করতে মাস্টারপ্ল্যানে জলাশয়কে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করে হাউজিংয়ের যোগ্য দেখানো হয়েছিল। সেই সরকারের কাছে তো আপনি আদালতের রায় বাস্তবায়নের আশা করতে পারেন না। কিন্তু এখন তো বাস্তবতা ভিন্ন। এখন আইনের শাসনের দিকে যেতে হলে জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মধুমতি মডেল টাউন সাভারের বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের আগস্টে এই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)। পরে ২০০৫ সালে এ প্রকল্পটি অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল পাঁচটি রিভিউ পিটিশন খারিজ করে পূর্বের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। রায়ের ছয় মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় রূপান্তর করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, নাম পরিবর্তন করে নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা।
তথ্য বলছে, মধুমতি মডেল টাউন নামে প্রায় ৫৫০ একর জমি ক্রয় করে মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে কোনো কোম্পানি কিংবা ব্যক্তির মালিকানাধীন ১০০ একরের বেশি জমি থাকার নিয়ম নেই। এখন অবৈধ এ হাউজিংয়ে একাধিক ডুপ্লেক্স বাড়ি, রাজমহল, লেকভিউ, জিওন, কল্লোল কুটির, ছায়াবিথী-১, ছায়াবিথী-২সহ ১০টি রিসোর্ট, তিন শতাধিক একতলা ভবন এবং প্রায় দুইশ টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০০ স্থাপনা রয়েছে মধুমতিজুড়ে। এলাকাটির ভেতরে রয়েছে একাধিক অভিজাত রেস্তোরাঁ। নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও রিসোর্টসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
অভিযোগ রয়েছে, দেশের দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বড় বড় মাদকের চালান এসে নামে এই হাউজিংয়ের ভেতর। পরে সেখান থেকেই এসব মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়া প্রতিদিন রাতেই এই হাউজিংয়ের বিভিন্ন রিসোর্টে বসে অবৈধ জুয়া ও মাদকের আসর। সঙ্গে অসামাজিক কার্যকলাপ।
মধুমতি মডেল টাউনের এক প্লট মালিক বলেন, এখানে কেউ স্থাপনা তৈরি করলে বাতেন-বাদল সিন্ডিকেটকে দিতে হয় উপঢৌকন (চাঁদা)। মডেল টাউনের সামনের অংশ (মহাসড়ক) দখল করে অবৈধ গাড়ি পার্কিং বানিয়ে ভাড়া দিয়েও বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। এসব ঘটনায় সাভার মডেল থানায় একাধিক মামলাও হয়েছে বাতেন-বাদল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এত মামলার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তারা। এই দুজনের অত্যাচারে অনেকেই এলাকা ছাড়া।
সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর সাভার মডেল থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলা হয় হাজি বাতেন ও বাদলসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এর পরও থেমে নেই তাদের দৌরাত্ম্য। নিরাপত্তাজনিত কারণে প্লট মালিক পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি বলেন, ‘বাতেন-বাদল আমার জমি দখল করে ভুয়া কাগজ বানিয়ে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি নিজের জমিতে যেতে পারি না। তারা এভাবে আমার জমি দখল করছে। আমি আমার জমি ফেরত চাই।’
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরির্তনের পর এই দুজন আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু আড়ালে থেকে নিজেদের লোক দিয়ে অপরাধমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছাত্র হত্যার মামলা হয়েছে দুজনের নামে। বর্তমানে তারা পলাতক থাকায় অভিযোগ বিষয়ে কথা বলতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। দুজনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বকর সরকার কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এসবের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসন সরকারের সব আদেশ ও নির্দেশ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।