বর্ষায় হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। আর বর্তমানে পর্যটকদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল সুনামগঞ্জের হাওরবাসীর জীবন ও জীবিকা। বর্ষায় হাউসবোট ও নৌকায় পর্যটকরা হাওরে ঘোরাঘুরি ও রাতযাপনের সময় প্লাস্টিক, বিদেশি মদের বোতলসহ নানা অপচনশীল বস্তু হাওরে ফেলে যান। এতে শুকনো মৌসুমে কৃষক পড়ছেন ক্ষতির মুখে। বিশেষ করে মদের বোতলের ভাঙা অংশে রক্তাক্ত হচ্ছেন অনেক কৃষক। উপজেলার মাটিয়ান হাওরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে অহরহ।
এবারও বোরো আবাদের মৌসুমের শুরু থেকেই জমিতে কাজ শুরু করেছেন স্থানীয় কৃষক। হাওরের পানি সরে যাওয়ার পর সেখানকার কাদাজলে বোরো রোপণ করতে গিয়েই ঘটছে বিপত্তি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্ষার ভরা মৌসুমে পর্যটকরা যখন হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন, তখন তাদের অনেকেই এলাকান মদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিদেশি মদের বোতল ক্রয় করেন। মদ পান করার পর ভারী বোতলগুলো হাওরেই ফেলে দেন। শুষ্ক মৌসুমে হাওরের কাদাজলে ভরা জমিতে কৃষকরা যখন চাষাবাদ শুরু করেন, তখন এসব পরিত্যক্ত কাচের বোতলের ভাঙা অংশে ক্ষতবিক্ষত হয় তাদের হাত-পা। অনেকের ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে।
উপজেলার বড়দল গ্রামের পশ্চিমাংশে মাটিয়ান হাওরের চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকা কৃষকরা এ নিয়ে ব্যাপক ভোগান্তিতে রয়েছেন। ভাঙা কাচের বোতলের টুকরোতে প্রায়ই রক্ত ঝরছে তাদের। কৃষকদের অভিযোগ, তারা কৃষিজমিতে চাষাবাদ এবং রোপণ কাজের সময় প্রায়ই এসব ভাঙা কাচে রক্তাক্ত হচ্ছেন। কাচে লেগে হাত-পা কেটে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আহত অবস্থায়ই তারা তাদের জমিতে কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃষকরা বলছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌভ্রমণের ক্ষেত্রে যাতায়াতকারীরা বর্ষা মৌসুমে ফাঁড়ি রাস্তা হিসেবে মাটিয়ান হাওরের মধ্য দিয়ে চলাচল করেন। অনেক সময় পর্যটকরা নৌকা মাটিয়ান হাওরে নোঙর করে রাতযাপন করেন। এ সময় তারা মদের খালি কাচের বোতল হাওরে ফেলে দেন, যা কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাটিয়ান হাওরপারের বড়দল নতুন হাটি গ্রামের কৃষক মিলন মিয়া জানান, তিনি ট্রাক্টর দিয়ে নিজের ও অন্যের জমি চাষাবাদ করে থাকেন। চাষাবাদের সময় জমিতে থাকা খালি বোতল ট্রাক্টরের ধারালো ফলায় আঘাত লেগে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। পরে এসব ভাঙা কাচের টুকরাতে আহত হন কৃষকরা। জমিতে কাজ করতে গিয়ে তিনিসহ স্থানীয় বশির আহমদ, নুরুল আমিন, জামাল হোসেন, সাজুল হক, উজ্জ্বল মিয়া, ছয়ফুল আলম, নুরুজ্জামান মিয়া, মকবুল হোসেন, কামাল হোসেন, সুয়েব মিয়া, টিপু মিয়া, শাহরিয়াসহ অনেকেই এসব ভাঙা কাচের টুকরাতে রক্তাক্ত হয়েছেন একাধিকবার। এসব কাচের বোতলের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশি মদের বোতল।
মাটিয়ান হাওরের কৃষক সালাম মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে আসা পর্যটকদের নৌকা যাতে নদীপথে যাতায়াত না করেন এবং কোনো নৌকা যেন হাওরে রাতযাপন করতে না পারে সেদিকে প্রশাসনের দৃষ্টি রাখতে হবে।
হাউসবোট চালক মহিবুর মিয়া বলেন, বর্ষাকালে পর্যটকবাহী নৌকাগুলো টেকেরঘাটে রাতযাপন করে। মূলত টেকেরঘাট থেকেই পর্যটকরা মদের বোতল কিনে নেন। টেকেরঘাট ও যাদুকাটা নদীতে চলাচলকারী পর্যটকরা বেশির ভাগই মাটিয়ান হাওরের বড়দল গ্রামের পশ্চিমাংশ দিয়ে চলাচল করেন। অনেক সময় নিরাপদে মাদক সেবনের জন্য মাটিয়ান হাওরেই নোঙর করে রাতযাপনও করেন। এসময় খালি কাচের বোতল ফেলে যাওয়ায় হাওরপারের কৃষকদের এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশ্মীর রেজা বলেন, হাওরে যেখানে-সেখানে কাচের বোতল, প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হলে কৃষিজমি, কৃষক ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। জরুরি ভিত্তিতে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী নৌকাগুলোকে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সেই সঙ্গে পর্যটকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। তাদের এমন অসচেতন আচরণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনি ব্যবস্থাও নির্ধারণ করা যেতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম জানান, মাটিয়ান হাওরে কাচের ভাঙা বোতলে কৃষকদের রক্তাক্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি জেনেছেন। এটি অত্যন্ত আপত্তিকর। এ ব্যাপারে তিনি শিগগিরই টাঙ্গুয়ার হাওরের নৌ-চালকদের নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করবেন। পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দায়িত্বশীল হওয়ারও আহ্বান জানিয়ে এই প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্লাস্টিক বর্জ্য সংরক্ষণে ডাস্টবিন ব্যবহারের প্রতি জোর দেন।