মামলার আসামি আরেকজন। বয়স, বাবার নাম, গ্রামের ঠিকানাও আলাদা। অথচ শুধু নামের মিল থাকায় যুবকের জায়গায় সাজা খাটছে অন্য এক শিশু। অনৈতিক সম্পর্ক এবং স্বর্ণালংকার চুরির একটি মামলায় শিপন মোল্লা নামের ওই শিশুটি ১১ দিন ধরে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সাজা খাটছে।
১৬ বছরের শিপন বরিশালের কর্ণকাঠি এলাকার রিয়াজ মোল্লার ছেলে। রিয়াজ মোল্লা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক এবং স্বর্ণালংকার চুরির অভিযোগে ২০২৩ সালে মামলা করেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সরোয়ার। তাতে আসামি করা হয় বরিশালের চর আইচার বাসিন্দা খালেক হাওলাদারের ছেলে শিপনকে (৩৪)। ওই মামলায় গত ২৯ জানুয়ারি রাতে শিশু শিপন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে বরিশাল বন্দর থানা পুলিশ। পরের দিন তাকে আদালতে চালান দেওয়া হয়। তারপর আদালত বয়স বিবেচনায় শিশু আইনে শিপন মোল্লাকে কারাগারে না পাঠিয়ে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের হেফাজতে পাঠায়। এরপর থেকে সেখানে সাজা খাটছে শিশুটি। শিশু শিপন সাজা খাটলেও সে মামলার আসামি নয়। এমনকি মামলার বাদীও তাকে চেনেন না। শুধু নামের মিল থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাবার নাম, গ্রাম ও বয়স ভিন্ন হলেও শুধু নামের মিলে সাজা খাটতে হচ্ছে তাকে।
জানতে চাইলে ভুক্তভোগী শিপন মোল্লার বাবা রিয়াজ মোল্লা কালবেলাকে বলেন, আমার ছেলের নামে কোনো মামলা নেই। সে ইটভাটায় কাজ করে আমাদের সংসার চালায়। কোনো অপরাধ না থাকলেও অন্য একজনের মামলায় আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। বারবার অনুরোধ করার পরও তারা ছাড়েনি। আমার ছেলে কোনো অপরাধ না করেও সাজাভোগ করেছে। তিনি বলেন, মামলার বাদীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, সে জানিয়েছে তারা আমার ছেলেকে চেনে না। আমার ছেলের বিরুদ্ধে তারা মামলা করেনি।
বিষয়টি স্বীকার করে মামলার বাদী সরোয়ার কালবেলাকে বলেন, আমাদের মামলায় যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাকে আমরা চিনি না। আমরা যে শিপনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম, তার বয়স ৩৪। অথচ পুলিশ ১৬ বছরের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন পুলিশ আমাদের মামলা তুলে নিতে বলছে। পুলিশ বলছে শিশুটিকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিপনের আইনজীবী শহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আসামি শিপন আর কারাগারে যাওয়া শিপন এক নয়। মামলার নথিতে আসামি শিপনের বাবার নাম আর ভুক্তভোগীর বাবার নাম ভিন্ন। এ ছাড়া বয়স এবং বাড়ির ঠিকানাও আলাদা। পুলিশের ভুলে সাজা খাটছে নিরপরাধ শিপন। আমরা এর বিচার চাই। কাল (আজ) আদালতে ভুক্তভোগীর জামিন চাইব।
মামলা সম্পর্কে এ আইনজীবী বলেন, মামলাটিতে আরেকজনের স্ত্রীকে বাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় স্বর্ণালংকার চুরির অভিযোগ করা হয়েছে। মামলার আসামির সঙ্গে বাদীর আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেও কারাভোগ করা শিপনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি ভুল হয়েছে বলে বাদী ও পুলিশের পক্ষ থেকে মীমাংসা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিপন মোল্লাকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বন্দর থানার এএসআই সেলিম রেজা, মোশারফ ও শাহাবুদ্দিন। বন্দর থানা পুলিশ বলছে, ওয়ারেন্টে এবং মামলার নথিতে বাবার নামে ভুল হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। কারণ মামলার নথিতে বাদী আসামির বাবার নাম ভুল করে রিয়াজ মোল্লা লিখেছিল। সেই ভুলের কারণে শিপন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ নথিতে ভুল থাকার কথা বললেও বিষয়টি নিয়ে তাদের গাফিলতি ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ শুধু বাবার নাম নয়, গ্রাম এবং বয়স আলাদা। তারপরও যাচাই-বাছাই না করেই একটি শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে থানার নারী ও শিশু বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে জানানোর কথা থাকলেও এ বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষকরা বলছেন, এখানে পুলিশের গাফিলতি ছিল, সেটা স্পষ্ট। একে তো তারা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করেনি। অন্যদিকে, তাদের গাফিলতির কারণে নিরাপদ একটি শিশু সাজাভোগ করছে। এই কাজে যারা জড়িত ছিল, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী শিশুকে দ্রুত ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এদিকে যাচাই-বাছাই না করে গ্রেপ্তার করায় নিজেদের ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে বর্তমানে বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করছে বন্দর থানা পুলিশ। এ জন্য মামলার বাদী এবং ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন গ্রেপ্তারের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যরা। মামলার বাদীকে মামলা তুলে নিতে এবং ভুক্তভোগীর বাবাকে বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর থানার ওসি রকিবুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি আমার ভালো জানা নেই। আপনি বলার পর শুনলাম। ঠিক আছে, আমি বিষয়টি দেখব। ওসি বিষয়টি জানেন না বললেও গ্রেপ্তারের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ওসির নির্দেশেই তারা শিপন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করেছেন।
গ্রেপ্তার অভিযানে থাকা জড়িত থানার এএসআই সেলিম রেজা কালবেলাকে বলেন, বাবার নাম মিল থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য বিষয়গুলো যাচাই করা দরকার ছিল, কিন্তু সেটা করা হয়নি। তিনি বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি। তবে আমাদের কাছে বয়স এবং এলাকা নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। ওসি স্যারকে বলেছিলাম আরও যাচাই-বাছাই করা দরকার, কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। ওসি আমাদের বলেছিলেন, যেহেতু ওয়ারেন্ট আছে, চালান করে দেন। এখন আমরা বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করছি।