ঢাকার উত্তরা পশ্চিম এলাকার ১২ নম্বর রোডের বাসিন্দা আব্দুল কাদের। ৭১ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তার। আব্দুল কাদেরসহ তার স্ত্রী ইসলামা বেগম, তিন ছেলে মাহমুদুল কবীর, মোহাম্মদ মঞ্জুরুল কবির ও মোহাম্মদ মোকতাদির কবীরের নামে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় রয়েছে ৬ কাঠা জমি। এ ছাড়া বাউনিয়া মৌজায় ১৭ কাঠা, রূপনগর আবাসিক এলাকায় আড়াই কাঠা, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় দোকান, সিটি প্লাজার নিচতলায় দোকান ও দয়াগঞ্জ মার্কেটে রয়েছে আরও একটি দোকান। এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। আর এসব সম্পত্তি দখলে নিতে ফুলবাড়িয়া সিটি প্লাজা সুপার মার্কেটের সহসভাপতি মাহবুব হোসেন নিয়েছেন ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয়। নিজেসহ পাঁচজনের একটি চক্র তৈরি করে ছবি, স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভুয়া দলিল তৈরি করেন তিনি।
জালিয়াতির এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় আব্দুল কাদেরের ছেলে মাহমুদুল কবীর বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। পরে ডিবির তদন্তে ও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব টেস্টে জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। মামলার অভিযোগপত্র দেয় তদন্তকারী সংস্থা ডিবি। কিন্তু ৬ বছরেও শুরু হয়নি আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ। গ্রেপ্তারের পর জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আসামিরা। বছরের পর বছর আসামিদের আবেদনে একাধিকবার তারিখ পেছানোসহ দুবার আদালতই পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে থমকে আছে ভয়াবহ জালিয়াতি মামলার বিচার।
মামলার অন্যতম আসামি জালিয়াতি চক্রের সহযোগী বাদীর ভাগনে ওসমান গণি দিপু (২৩) গ্রেপ্তারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দি থেকে জানা যায়, রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার চতুর্থ বর্ষের ছাত্র দিপু। বৃদ্ধ আব্দুল কাদের সম্পর্কে তার নানা। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকার কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন আব্দুল কাদের। ছেলেরা তার সঙ্গে থাকত না বলে মাঝেমধ্যে দিপু তার দেখাশোনা করতেন। এক দিন দিপুরে দুই বন্ধু সেতু ও রায়হান নানার কিছু সম্পত্তি দিপুর নামে করে নিতে প্রলোভন দেখায়। এরপর ওই দুই বন্ধু হারুন অর রশিদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে দিপুর পরিচয় করিয়ে দেন। হারুন জমি-সংক্রান্ত কাজ করেন। এক দিন হারুন দিপুকে তার নানার সম্পত্তির দলিলগুলো আনতে বলেন। হারুনের কথামতো দিপু তার ‘নানা’ আব্দুল কাদেরের বাসা থেকে দলিলের ফাইল চুরি করে এনে হারুনকে দেন। প্রথম দফায় আব্দুল কাদেরের মিরপুরের ৬ কাঠা জমির দলিল, বাউনিয়ার ১৭ কাঠা জমি ও রূপনগর আবাসিক এলাকার আড়াই কাঠা জমির দলিলসহ যাবতীয় কাগজ দেন দিপু। পরে গুলিস্তানের সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ৩ নম্বর দোকান, সিটি প্লাজার নিচতলায় ৮৩ নম্বর দোকান ও দয়াগঞ্জ মার্কেটের ৬০ নম্বর দোকানের চূড়ান্ত বরাদ্দপত্রের মূলকপি, দখলস্বত্ব প্রদানের মূলকপি, হস্তান্তরপত্র, চুক্তিপত্র এবং ভাড়া রশিদের মূলকপি চুরি করে হারুনকে দেন দিপু। এসব সম্পদের দলিলের কাগজ নেওয়ার পর হারুন আর দিপুর ফোন ধরছিলেন না। পরে দিপু তার অফিসে গেলে জমির দলিল-কাগজ নেননি বলে জানান হারুন। এ সময় দিপু হারুনের পায়ে পড়ে কান্না করে বলেন, ‘আমি জমির মালিক হতে চাই না। আমার নানার জমির দলিল ফেরত দেন।’ এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে দিপুকে হত্যার হুমকি দেন হারুন। কয়েকদিন পর মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে দিপু তার নানা আব্দুল কাদের ও মামাদের সব ঘটনা খুলে বলেন।
এদিকে এসব দলিল নিয়ে আব্দুল কাদের ও তার পরিবারের সদস্যদের ছবি, স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপের পরিবর্তে অন্য ব্যক্তিদের ছবি, স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে জমি ও দোকানের জাল দলিল তৈরি করেন হারুন অর রশিদসহ পাঁচজন। এ মামলা তদন্ত করে হারুন অর রশিদকে ১ নম্বরসহ পাঁচজনকে আসামি করে ২০১৯ সালের ৩০ মে ডিবির পরিদর্শক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে মমালার ৩ নম্বর আসামি ফুলবাড়িয়া সিটি প্লাজা সুপার মার্কেটের সহসভাপতি মাহবুব হোসেনকে এ জালিয়াতির মূল পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করা হয়। বাকি আসামিরা হলেন ওসমান গনি দিপু, ওয়াহিদ আরমান ও জাহাঙ্গীর ফারুক।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আব্দুল কাদেরের সব বিষয়সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করার উদ্দেশ্যে তার আত্মীয় ওসমান গনির মাধ্যমে দলিল চুরি করে মূল পরিকল্পনাকারী মাহবুব হোসেনসহ বাকি আসামিরা। এরপর আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে আব্দুল কাদেরের ফুলবাড়িয়ার ৮৩ নম্বর দোকানের দখলস্বত্ব উত্তরা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেনের নামে হস্তান্তর ও পজিশন বিক্রির দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে এনায়েত হোসেন আসামি মাহবুব হোসেনের কাছে দোকানের দখলস্বত্ব বিক্রি করেছেন বলে দেখানো হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজার শাখা-২ থেকে নিজের নামে দোকানের নামজারিও করে নেন মাহবুব।
এদিকে ছবি-স্বাক্ষর ব্যবহার করা হলেও ফুলবাড়িয়া দোকানের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকার করেছেন এনায়েত হোসেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘আমি ছবি বা স্বাক্ষর দিইনি। পুলিশ এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমি অবাক হই। আমি দলিলদাতা আব্দুল কাদেরকে কখনো দেখিনি। এ দলিলের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই।’
গ্রেপ্তারের পর ভুয়া আমমোক্তারনামা করা জাহাঙ্গীর কবীরও তার দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
জমির জালিয়াতির বিষয়ে অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মিরপুরের ৬ কাঠা জমি আব্দুল কাদেরসহ মালিকানাধীন পরিবারের পাঁচ সদস্যের ছবি, স্বাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের পরিবর্তে জালিয়াতি করে ভিন্ন পাঁচজনের ছবি, সাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট বসিয়ে আসামি হারুন অর রশিদের নামে আমমোক্তারনামা করা হয়। এতে জাহাঙ্গীর কবীরকে সাজানো হয় আব্দুল কাদের। এরপর কাদেরের ছবি, স্বাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্টের জায়গায় জাহাঙ্গীরের ছবি, স্বাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া হয়। বাকি সাজানো চারজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব টেস্টে আব্দুল কাদেরের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভুয়া এই পাঁচজনের ছবি, স্বাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলেনি বলে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ৬ বছর কেটে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু করা যায়নি। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর মামলার বিচারের জন্য প্রথমে ঢাকার ১৪ নম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হয়। এরপর আসামিপক্ষ থেকে তিনবার চার্জ গঠনের সময় পেছানো হয়। পরে মামলা এই আদালত থেকে অন্য আদালতে বদলি করতে আবেদন করে আসামিপক্ষ। এভাবে দেড় বছর কেটে যায়। সিএমএম আদালত বদলির আবেদন নামঞ্জুর করলে আসামিপক্ষ ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার ২০ নম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হয়। পরে চার্জ গঠন শুনানি পেছাতে আসামিরা ৮ মাস সময় নেন। ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে চার্জ গঠনের মাধ্যমে মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এরপর মামলার প্রধান আসামি মাহবুব হোসেন চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে ৬ মাসের জন্য বিচার স্থগিত হয়ে যায়। আসামি হাইকোর্টে শুনানিতে না গিয়ে রুল ভ্যাকেট করেন। এরপর মামলার কয়েকটি সাক্ষীর তারিখ চলে গেলে ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আসামিপক্ষ আবেদনে জানায়, তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির যে ৪৬৭ ধারা আনা হয়েছে, সেটার বিচার করার এখতিয়ার ঢাকার ২০ নম্বর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নেই।
পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার ২ নম্বর অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষীর জন্য যায়। এরপর আসামিরা জানায় আগের আদালতে গঠিত চার্জ গঠন বৈধ নয়। পরবর্তী সময়ে তিনবার তারিখ পেছানোর পর ২ নম্বর অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফের চার্জ গঠন করা হয়। ফের চার্জ গঠন করিয়ে আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে গত বছরের ১ ডিসেম্বর আসামিরা ফের ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করেন। মহানগর আদালতে মামলাটি এখন পর্যন্ত রিভিশন পর্যায়ে আছে। এভাবে আসামিদের আবেদনে দুবার আদালত বদল করা হয়।
এ বিষয়ে মামলার বাদী মাহমুদুল কবীর কালবেলা বলেন, আসামিরা আমাদের জমির দলিল চুরিসহ আমার পরিবারের সদস্যদের ভুয়া ছবি, স্বাক্ষর ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে তাদের নামে জাল দলিল তৈরি করে। তদন্তে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সাজা হবে জেনে আসামিরা ৬ বছর ধরে মামলার বিচার আটকে রেখেছে। আসামিরা খুবই ধূর্ত ও প্রভাবশালী। তাদের আবেদনে আদালত বদল হয়েছে দুবার। আমরা এই ভোগান্তি ও জালিয়াতির সঠিক বিচার চাই।
মামলা ও জালিয়াতির বিষয়ে বক্ত জানতে ফুলবাড়িয়া সিটি প্লাজা সুপার মার্কেটের সহসভাপতি মাহবুব হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। আরেক আসামি ওসমান গনি দিপুকে বলেন, ‘আমি এখানে পুরোটাই ট্র্যাপে ছিলাম। আমার পরামর্শেই মামারা মামলাটি করেন। আমি দোষ করিনি। আমি চাই, যারা দোষ করেছে তাদের বিচার হোক।’
দীর্ঘদিন মামলাটি ঝুলে থাকার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী কালবেলাকে বলেন, ‘মামলার বিচার সময় দীর্ঘায়িত হলে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ৫ আগস্টের আগে মামলা ঝুলে থাকত। এখন আমরা বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে তাগাদা দিচ্ছি। প্রয়োজনে বাদী প্রসিকিউশনের সহযোগিতা নিতে পারেন।’