বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অগ্রাধিকারের তালিকায় বরাবরের মতো বেশ পিছিয়ে আছে। সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে এ দুই খাতের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে এলেও বাড়ছে না বরাদ্দ। উল্টো সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) ধারাবাহিকভাবে এ দুই খাতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। এবারও তার ব্যত্যয় হচ্ছে না। ফলে চার বছর ধরেই এ দুই খাতে বরাদ্দের নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বরাবরের মতো চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে বড় কাটছাঁট করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। এরই মধ্যে আরএডিপির বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি আরএডিপি নিয়ে বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আরএডিপি চূড়ান্ত হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে আরএডিপিতে বরাদ্দ ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে আরএডিপির আকার দাঁড়াবে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
বিগত কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এডিপিতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বরাদ্দ কমানো হয়েছিল। কিন্তু এবার বরাদ্দ কমানোর হার তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এবার প্রায় ১৮ শতাংশের বেশি কমতে যাচ্ছে এডিপির আকার। এদিকে আরএডিপিতে বরাদ্দ কমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাত। এই তিন খাতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে ৪৫ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বরাদ্দের ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু আরএডিপিতে সেখান থেকে ১২ হাজার ২১৯ কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকবে ৮ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, যা আরএডিপিতে মোট বরাদ্দের মাত্র ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।
অন্যদিকে, শিক্ষা খাতে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতে ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, যা ছিল মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। আরএডিপিতে শিক্ষা খাত থেকে ১১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই হিসাবে আরএডিপিতে মাত্র ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে শিক্ষা খাতে।
পরিকল্পনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিপি সংশোধনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ‘কোপ’ পড়েছে এ দুই খাতে। তাদের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় মূলত গুরুত্বপূর্ণ এ দুই খাতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে ২৩ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ দুই খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছিল সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে বরাদ্দ।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা মানব উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। কিন্তু বাজেটে স্বাস্থ্য খাত সবসময়ই উপেক্ষিত থাকছে। এ খাতে বরাদ্দ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় কমই থাকে। এখন আরও কমানো হলে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। বারবার সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে জোর দেওয়ার কথা বলা হলেও উন্নয়ন বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালবেলাকে বলেন, স্বাস্থ্যে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার চেয়ে তিনগুণ বরাদ্দ প্রয়োজন। সেখানে বরাদ্দ থেকে কেটে নেওয়া ভালো কথা নয়। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা থেকে কম কাটা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক খাত বা অন্য খাতের কাজ বন্ধ রেখে পরবর্তী সময়ে শুরু করা যায়; কিন্তু স্বাস্থ্যের কোনো কার্যক্রম বন্ধ করা হলে, সেটা আবার শুরু থেকে শুরু করতে হয়। তাই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে যত কম কাটছাঁট করা যায়, ততই ভালো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আরএডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে ১০টি খাত। এ খাতগুলোর জন্য মোট বরাদ্দে প্রায় ৮১ দশমিক ৩১ শতাংশ রাখা হয়েছে। খাতভিত্তিক বরাদ্দের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া প্রায় সব খাতেই কমবেশি বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। শুধু পরিবেশ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে।
প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে কমানো হচ্ছে ২২ হাজার ৪৩৪ কোটি; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে ৮ হাজার ৮৫৪ কোটি; গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধা খাত থেকে ৫ হাজার ২২৩ কোটি; স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন থেকে ১ হাজার ৩৩ কোটি; কৃষি থেকে ৩ হাজার ৫৮৮ কোটি; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাত থেকে ২ হাজার ৪৩ কোটি এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ৪৫৯ কোটি টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ খাতে ৫৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এতে এ খাতে আরএডিপিতে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা।
জানা গেছে, আরএডিপিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য ২১ হাজার ৪৭৫ কোটি, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য ১৮ হাজার ৬২৪ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১২ হাজার ৭৬৪ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য ১২ হাজার ১২৯ কোটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১০ হাজার ২২৭ কোটি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১০ হাজার ২১১ কোটি, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭ হাজার ১৫৩ কোটি, সেতু বিভাগের জন্য ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।