কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রয়েছে শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক। শুধু কেরানীহাট থেকে চুনতি পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার অংশেই রয়েছে ১০টিরও বেশি। এসব বাঁকে নেই দিকচিহ্ন-সংবলিত সাইনবোর্ড কিংবা ফলক। এ ছাড়া দুই পাশে ঘন জঙ্গল থাকায় দূর থেকে সহজে বোঝাও যায় না। সবকিছু মিলে মহাসড়কটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঝরছে প্রাণ। শুধু ঈদের তিন দিনেই এ সড়কে মারা গেছে অন্তত ১৫ জন। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হটস্পট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে লোহাগাড়ার চুনতির জাঙ্গালিয়া। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে আসছে সড়কের অপ্রশস্ততা, চালকের দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া, বিপজ্জনক বাঁক, লবণের পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ার মতো নানা বিষয়। স্থানীয়দের কেউ কেউ আবার এখানে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির হাতকেও দুষছেন। তবে দুর্ঘটনা কমাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, তিন দিনে একাধিক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসেছে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল। সবশেষ গত বুধবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীরপ্রতীক)। সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমসহ শীর্ষ কর্তারা। পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতের নেতারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, শিগগির চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সড়কের উভয়দিকে ১ কিলোমিটারের মধ্যে গতিরোধক স্থাপনের কাজও শুরু হবে। অবৈধ যানবাহনের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, লবণবাহী ট্রাকগুলো যথাযথ নিয়ম ও সতর্কতা অবলম্বন করছে কি না, সে বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, শুধু জাঙ্গালিয়া নয়, পুরো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সমস্যা প্রায় একই। একদিকে সরু সড়ক, তার ওপর একের পর এক বিপজ্জনক বাঁক। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া লবণবাহী গাড়ি থেকে প্রতিনিয়তই পানি চুইয়ে পড়ে সড়কের ওপর। যে কারণে সড়ক হয়ে যায় পিচ্ছিল। আবার পর্যটন শহর কক্সবাজারে যাতায়াত করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চালকরা। তারা বিপজ্জনক বাঁক আর সড়কের গঠন সম্পর্কে অজ্ঞাত। ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় হরহামেশাই।
স্থানীয় নেওয়াজ হোসেন জানান, চুনতির ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের পাশে জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাজার রয়েছে। সেখানে প্রায় সময় চালকরা নাকি একের অধিক সড়ক দেখতে পান। বিষয়টা সত্যি মনে হয়। না হলে একই স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটবে কেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি নামেমাত্র মহাসড়ক। অনেক আঞ্চলিক সড়কও এর চেয়ে প্রশস্ত।
জানা যায়, দেশের প্রধান পর্যটন স্পটে কক্সবাজারে সড়কপথে যাতায়াতের এটিই প্রধান মাধ্যম। নানান সময় চার লেনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হলে বাস্তবে আলোর মুখ দেখে না প্রকল্পটি।
লোহাগাড়ার বাসিন্দা ব্যাংকার মোহাম্মদ আবদুল জলিলের মতে, সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পাশাপাশি লবণবোঝাই গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে। লবণের গাড়ির কারণে রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত রাস্তা বিপজ্জনকভাবে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ৫ হাজার ৭০৯ কোটি ও বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা প্রদান করার কথা ছিল। ২০২৩ সালে একনেকে পাস হলেও এ প্রকল্পের মূল কাজ কবে শুরু হবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে এরই মধ্যে জাইকার প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন ও পরামর্শ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কনসালট্যান্ট নিয়োগের আগে আরও কিছু ধাপ শেষ করতে হবে। কনসালট্যান্ট নিয়োগ হলেও টেন্ডার দিয়ে কাজ শুরু করতে এ বছর শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার দিলে কাজ এ বছরই শুরু করতে পারব। তিনি আরও জানান, জাইকার অর্থায়নে মহাসড়কের পটিয়া, চানখালী, কক্সবাজারের মাতামুহুরী, চন্দনাইশের শঙ্খ ও বরুমতী খালের ওপর ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি অত্যাধুনিক পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার পাশাপাশি গরু-ছাগলও চলাচল করে। সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা এটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এই সড়কের উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কারণ সে বিষয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি সংশ্লিষ্টরা। কিছু স্থানে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে প্রশস্ত করা হলেও সেটি স্থায়ী সমাধান নয়। আগে অবশ্যই চার লেনের করতে হবে। তবে ছয় কিংবা আট লেনের নিচে রাখলে সড়কটি নিরাপদ হবে না। চকরিয়ার সড়কটি আলাদা উঁচু করে রেলিং করা হয়েছিল। এখন সেখানে আবকার হাট-বাজার বসছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘লবণ পানি, সকালের কুয়াশায় পিচ্ছিল ও ভেজা থাকে সড়ক। এ ছাড়া যানবাহনের তুলনায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি সরু। সড়ক প্রশস্ত করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে।’
লোহাগাড়ার ইউএনও ইনামুল হাছান বলেন, জাঙ্গালিয়া এলাকায় গতিরোধক দেওয়ার জন্য জানিয়েছিলাম। যাতে অপরিচিত চালকরাও গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তখন অবশ্য প্রকৌশলীরা আমাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। সবশেষ দুর্ঘটনার পর গতিরোধক স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি, অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে চার লেনের কাজও শুরু হবে।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি শুভরঞ্জন চাকমা বলেন, ‘চুনতি-জাঙ্গালিয়া সড়কটি দুর্ঘটনপ্রবণ হওয়ায় ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত। যেই স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে তা পাহাড়ি জায়গার মতো ঢালু। এ ছাড়া পূর্ব পাশের একটি অংশ নিচু। পশ্চিম অংশ উঁচু। আশপাশে বসতি তেমন নেই। স্থায়ী সমাধান করতে হলে বাঁকগুলো সোজা করে দিতে হবে। রাস্তা সমান করে প্রশস্ত করতে হবে। লেন বাড়ানোর পাশাপাশি ডিভাইডার দেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি।’
মন্তব্য করুন