দীর্ঘ দেড় দশক পর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠককে কেন্দ্র করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৈঠক নিয়ে পাকিস্তানের ভাষ্যে অতীতের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আলোচনা না আসা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং স্বাধীনতাপূর্ব অভিন্ন সম্পদের বকেয়া অর্থ পরিশোধের দাবি তুলে ধরা হলেও বৈঠক প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব ইস্যুর কোনোটাই প্রকাশ করেনি দেশটি।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে ৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ৪৩২ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গও উত্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দকৃত বৈদেশিক সাহায্যের যথাযথ হস্তান্তর এবং অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রসঙ্গও আলোচনায় ছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব।
বৈঠক নিয়ে গত শুক্রবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বৃদ্ধির নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াসহ বকেয়া অর্থ পরিশোধের প্রসঙ্গের উল্লেখ নেই। পাকিস্তানের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, অভিন্ন ইতিহাস ও জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত ও কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া কানেক্টিভিটি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে করাচি-চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল এবং ফের সরাসরি বিমান সংযোগ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে হওয়া এফওসি বৈঠকে আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গের কথা হয়েছে জানিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা এবং জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কাশ্মীর পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অনুযায়ী সমাধানের ওপর জোর দেন। এ ছাড়া, সার্ক পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তার ওপরও দুই দেশের আলোচনা হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে একেবারেই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চালিয়ে যেতে চায় দেশটি এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে নিতে চায়। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং বকেয়া অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি সুরাহা ছাড়া সম্ভব নয় বলছেন কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ কথা বলেছে, তা দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু। সুতরাং সম্পর্ক ভালো রাখতে হলে আগে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর জট খুলতে হবে। অন্যথায় সম্পর্ক উন্নয়নের অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে না।
বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর পর হওয়া এফওসি বৈঠকে ১৯৭১ সালে হওয়া গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং বাংলাদেশের পাওনা নগদ অর্থের দাবির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াকে কীভাবে দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা তা জানতে কালবেলা কথা বলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চলা গণহত্যাসহ অর্থ বকেয়া—এগুলো তো একেবারে সুনির্দিষ্ট (স্পেসিফিক)। আমরা আমাদের অবস্থানটা পরিষ্কার করেছি। পাকিস্তান হয়তো তাদের স্পর্শকাতর (সেনসিটিভ) জায়গা থেকে এ বিষয়গুলো প্রকাশ করেনি। প্রকাশ করেনি মানে এই নয় যে, তারা বিষয়গুলো গ্রহণ করেনি। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে অমীমাংসিত ইস্যু, সেগুলোয় বাংলাদেশের একটা বড় কনসার্ন আছে, যা তারা (পাকিস্তান) বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করেনি।
এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলে এ অমীমাংসিত বিষয়গুলো অবশ্যই তাদের সুরাহা করতে হবে। আমার কাছে মনে হয় পাকিস্তানের বর্তমান সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী। সেক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে হলে আমাদের যে মৌলিক জায়গাটা, সেখানে তাদের মনোযোগী হতে হবে। সেটা হলে আমি মনে করি দুদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব। আর এটা উভয়পক্ষের জন্যই ইতিবাচক।
বাংলাদেশের উত্থাপিত বিষয়গুলোয় পাকিস্তান গুরুত্ব না দিলে বাংলাদেশ স্বাভাবিক সম্পর্ক এগিয়ে নেবে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। যেহেতু বাংলাদেশ বিষয়গুলো তুলেছে, তাই পররাষ্ট্র সচিব সেখানে তাদের উচ্চ পর্যায়ের অবগত করবেন। তারপর রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত হবে বিষয়টি নিয়ে। এর বাইরে তো ব্যবসা-বাণিজ্য হতেই পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ হয় কি না, দেখতে হবে। কারণ তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো। তাই লাভবান না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহী হবে না কেউ। এর বাইরেও দুদেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক বাড়াতেও কাজ হতে পারে।
তিনি বলেন, তারা তো টাকাগুলো আটকে রেখেছে। টাকাগুলো তো পাকিস্তানের নয়। আমাদের দেশের লোন, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ নানা খাতের টাকা। আমি মনে করি বাংলাদেশ ইন্টারেস্ট ছাড়া সেই আগের টাকাটাই চাইছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের বড় সুযোগ দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশ পারত এত বছরের ইন্টারেস্টসহ অনেক বেশি টাকা দাবি করতে। তারা এমন কেন করছে? তারা তো একাত্তর থেকে বেরিয়ে আসছে না। আর ক্ষমা চাইলে তো ক্ষতি নেই। জাপানও তো কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। আরও অনেক দেশ চেয়েছে।
মন্তব্য করুন