সজিব ঘোষ
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ জুন ২০২৫, ১২:০৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের কঠিন পথ

হতাহতের ৯৬% পাচ্ছে না ক্ষতিপূরণ
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের কঠিন পথ

দেশের সড়কে প্রতিদিনই ঝরছে বহু প্রাণ, কারওবা হচ্ছে অঙ্গহানি। সড়ক দুর্ঘটনায় এসব হতাহতের জন্য সরকারি তহবিল থাকলেও তা থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ সহজ নয়। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার বা আহতরা ক্ষতিপূরণ পাবেন আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে। এ তহবিলে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি জমা থাকলেও আইনি ও দাপ্তরিক নানা জটিলতায় হতাহতের ৯৬ শতাংশই পাচ্ছে না ক্ষতিপূরণ।

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা নিহতের ক্ষেত্রে তার পরিবারের সদস্যরা ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আবেদন করতে পারছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রথম ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় থেকে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১১৯টি ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

যদিও খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৩ হাজার ৩৩২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১২ হাজার ৩৯১ জনের। আহত হয়েছেন অন্তত আরও ১৬ হাজার ২৩৮ জন। এর মধ্যে নিহতদের পক্ষে ৯৪৮ পরিবার ৫ লাখ টাকা করে চেক পেয়েছে। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়েছেন—এমন ৩৫ জন পেয়েছেন ৩ লাখ টাকা করে চেক। আর অন্য আহতদের মধ্যে ১৩৬ জন পেয়েছেন ১ লাখ টাকা করে চেক।

অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনার শিকারদের মধ্যে গত মাস পর্যন্ত মাত্র ৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। বাকি ৯৬ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের বাইরে আছেন। এ সময়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয়েছে মোট ৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে একটি তহবিল করা হয়েছে। সেই তহবিলের টাকা সোনালী ব্যাংকে একটি হিসাব খুলে জমা রাখা হয়েছে। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে তহবিলের ২৬৮ কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ক্ষতিপূরণের টাকা বিতরণের গতি নেই।

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন কালবেলাকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের আবেদন জেলাভিত্তিক নেওয়া হয়। প্রাথমিক বাছাই শেষে ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদনগুলো আসে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া কীভাবে আরও সহজ করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে।’

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, প্রতি বছর অন্তত ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে—এমন ভাবনা রেখেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু দুই বছরে ৫০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। উল্টো ক্ষতিগ্রস্তদের তহবিলের ২৬৮ কোটি টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে। এতেই পরিষ্কার বোঝা যায়, ক্ষতিপূরণের কোনো টাকা দেওয়া হচ্ছে না।

অনলাইনে হতে যাচ্ছে ক্ষতিপূরণের আবেদন: ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের কথা বলা হলেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় প্রথম পাঁচ বছর ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করা যায়নি। প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বিআরটিএ সদর দপ্তরে আবেদন করতে হতো। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে আবেদন করতে হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওই কমিটিতে থাকেন। এ কমিটি ক্ষতিপূরণের আবেদনের সত্যতা অনুসন্ধান করে। এ ক্ষেত্রে জটিলতা হলো, কুমিল্লার বাসিন্দা সিলেটে দুর্ঘটনার শিকার হলে তাকে সিলেটে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে হয়। তাতে ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল হয়। এ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা যেখানেই হোক আক্রান্ত ব্যক্তি যেন নিজ উপজেলায় আবেদন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হয়।

গত ২০ মে ট্রাস্টি বোর্ডের বোর্ড সভা হয়েছে। জানা গেছে, ওই সভায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইনে আবেদন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে সব জেলায় নিজস্ব জনবল নেওয়ার বিষয়েও কথা হয়। তবে আলাদা জনবল নিতে নিয়োগ বিধি তৈরি করতে হবে। তাই আপাতত প্রতি জেলায় একজন করে অস্থায়ী জনবল নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে বোর্ডের সদস্য ও বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকার কে হবে, সেটি নির্ধারণ করা কঠিন হয়। আইনি জটিলতা শেষ করে উত্তরাধিকার চূড়ান্ত করে তাকে চেক দেওয়ায় প্রক্রিয়ায় কিছুটা দেরি হয়। তবে আহতরা যেন দ্রুত ক্ষতিপূরণ পান, সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে।’

গতিহীন ট্রাস্টি বোর্ডের কার্যক্রম: সড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, কোনো মোটরযানের কারণে দুর্ঘটনায় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসা খরচ দিতে হবে। আইনের ৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করা হবে। এ তহবিল পরিচালনা করতে প্রতিটি মোটরযানের বিপরীতে মালিকদের কাছ থেকে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা আদায় করা হবে। মোটরযান মালিক বা প্রতিষ্ঠান তহবিলে এ চাঁদা দিতে বাধ্য। পরের ধারায় বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দেখতে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হবে।

ট্রাস্টি বোর্ডের সভা, ব্যবস্থাপনা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে বলে ৫৮ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ট্রাস্টি বোর্ডের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। দুর্বল ট্রাস্টি বোর্ডের কারণে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ দীর্ঘ হচ্ছে।

বিআরটিএর উপপরিচালক (অডিট ও আইন) তানভীর আহাম্মেদ সিদ্দিক অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ট্রাস্টি বোর্ডে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ড মূলত আলাদা সংস্থা। কিন্তু সেখানে কোনো জনবল নেই। আমাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কাজ করতে হয়। ফলে নিয়মিত কাজ থাকলে সেখানে বেশি কাজ করা যায় না। এতে স্বাভাবিকভাবেই বোর্ডের কাজের গতি কমে যাচ্ছে।’

ক্ষতিপূরণের পথ কঠিন, শাস্তি কমানোর দাবি: আইনের ৫৯ ধারা অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ পেতে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তার বৈধ প্রতিনিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে পারেন। তবে দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। পরবর্তী সময়ে বোর্ড সভায় অনুমোদন পেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।

ক্ষতিপূরণ পেতে অনুসন্ধানে দুর্ঘটনা প্রমাণিত হতে হয়। পর্যাপ্ত প্রমাণ না দিতে পারা এবং আবেদন প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে অনেক আবেদনকারী ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। আক্রান্ত ব্যক্তি কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবেন, সেটিও ট্রাস্টি বোর্ডের অনুসন্ধানী দল নির্ধারণ করে। জেলা পর্যায়ে আবেদনের পর সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুমোদনের পর ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে আবেদন গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে আবেদন করা কঠিন। আগে চিকিৎসা নেবে নাকি আবেদন করবে। আর ক্ষতিপূরণের টাকা ছয় মাস পর না পেয়ে চিকিৎসা চলাকালে পেলে অনেক রোগীর জীবন বেঁচে যায়। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির সময় অনুসন্ধান নিশ্চিত করা গেলে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব। সেই টাকা দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করারও সুযোগ থাকে।’

এদিকে ২০১৮ সালে প্রণীত এ আইনের ১০৫ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি মারাত্মক আহত বা নিহত হলে দায়ী চালককে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে আহতদের বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। আর নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখের পরিবর্তে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হয়।

আইন ও ক্ষতিপূরণ পেতে জটিলতার বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হলে বীমা ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে। সবাইকে বীমার আওতায় আনার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া কার্যকর হবে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খাদ্য কর্মকর্তা কেজিতে ঘুষ নেন ৭৫ পয়সা

বাজেটকে ‘পুঁজিবাজারবান্ধব’ উল্লেখ করে স্বাগত জানাল ডিবিএ

বিমানে করে ঢাকা এলেন সৈয়দপুরের কসাই, আয় চমকে ওঠার মতো

স্কুলব্যাগে মিলল ৫ মাথার খুলি ও হাড়গোড়

আইসিটি শ্বেতপত্র প্রণয়নে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য আহ্বান

জবাবদিহি করেন না, প্রধান উপদেষ্টা মিষ্টি হাসি দিয়ে বিদায় করেন : মান্না

ভারতের মিথ্যাচার উন্মোচনে বিশ্বমঞ্চে জোর বাড়াচ্ছে পাকিস্তান

বাজেট বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে : ফরেন চেম্বার

ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করলেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী

ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি সাইফুলের বাড়ি-ফ্ল্যাট জব্দ

১০

পঞ্চগড় সীমান্তে এবার ২৬ জনকে বিএসএফের পুশইন 

১১

হজযাত্রীদের বহনকারী বাসে সেনাদের হামলা

১২

দোকানের শাটারের নিচ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল রক্ত, অতঃপর...

১৩

কোরবানিদাতাদের প্রতি আহমাদুল্লাহর বার্তা

১৪

গ্রামীণ টেলিকম পেল ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স

১৫

ড. ইউনূসকে মাওলানা রাব্বানী / ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখুন

১৬

সোনারগাঁয়ে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহের পুরস্কার বিতরণ

১৭

ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত 

১৮

‘গুজবে কান দেবেন না, এটাই আমার প্রথম বিয়ে’

১৯

আবারও ত্রাণকেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি সেনাদের হামলা, নিহত ২৭

২০
X