মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা দেশে উদযাপিত হবে আগামী ৭ জুন। সাধারণত ঈদের চার দিন আগে থেকে রাজধানীতে বসে কোরবানির পশুর হাট। ঈদের দিনও কোরবানির পশু কেনাবেচা হয়। সে হিসেবে কোরবানির পশুর হাট শুরু হওয়ার কথা আগামীকাল মঙ্গলবার। তবে সময়ের আগেই সিটি করপোরেশনের বিধিনিষেধ ভেঙে রাজধানীর অধিকাংশ স্থানে বসে গেছে হাট। এমনকি ইজারা ছাড়াই বসেছে কয়েকটি অবৈধ হাট। নির্ধারিত এলাকার বাইরে আশপাশের সড়ক, গলিপথ এমনকি আবাসিক ভবনের সামনেও পশু রাখা হচ্ছে। এতে তীব্র হয়েছে যানজট। ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। তবে এসব বিষয়ে সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের ঈদুল আজহায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার ১১টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) চার দফায় ১৪টি হাটের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর মধ্যে ডিএসসিসির আফতাবনগর ও মেরাদিয়ার পশুর হাট এবং ডিএনসিসির বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং ও বনরূপা আবাসিক এলাকার হাট জনবহুল স্থানে হওয়ায় আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। শ্যামপুরের হাটটি শেষ মুহূর্তে এসে ইজারাদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত করে করপোরেশন। কমলাপুর ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব সংলগ্ন হাট আর ধোলাইখালের হাটটি সরকারি মূল্যের চেয়ে কম হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এখনো হাট বসানোর অনুমতি আসেনি। এদিকে পশুর হাট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার এক দিন বাকি থাকলেও গতকাল রোববার মেরুল বাড্ডা কাঁচাবাজার, বালুর মাঠ ইকরা মাদ্রাসার পাশের খালি জায়গা ও মিরপুর কালসি খালি জায়গার হাটের দর উন্মুক্ত হয়েছে। এখনো বাকি যাচাই-বাছাই আর কার্যাদেশ দেওয়া। এ ছাড়া দুই সিটিতে মিরপুরের গাবতলী ও ডেমরার সারুলিয়ায় দুটি স্থায়ী পশুর হাট আছে।
দুই সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যেই পশুর হাট বসেছে। ইজারার নির্ধারিত জায়গা ছাড়িয়ে এসব হাট মহাসড়ক, আবাসিক এলাকা আর খেলার মাঠেও স্থান নিয়েছে। আগামীকাল থেকে হাটে বেচাবিক্রির শর্ত থাকলেও আগেই শুরু হয়েছে বেচাবিক্রি।
সরেজমিন দেখা যায়, ডিএনসিসির ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা হতে ১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ সংলগ্ন উত্তরা রানাভোলা সুইচগেট পর্যন্ত হাটের বিজ্ঞপ্তি দিলেও এখানে পশুর হাট বসেনি। হাট বসেছে ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের পাশে তুরাগ নদীর পাশে বেড়িবাঁধ আর আইইউবিএটি ক্যাম্পাসের পাশে। মোহাম্মদপুরের বছিলায় ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি আশপাশের সড়কে গিয়ে ঠেকেছে। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন খালি জায়গায় হাট বসার কথা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকলেও হাট বসানো হয়েছে খেলার মাঠে। মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার খালি জায়গা ছেড়েও পল্লবী পর্যন্ত হাট বসানো হয়েছে। খিলক্ষেত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের হাটটিও নির্ধারিত জায়গা ছাড়িয়ে গেছে। মস্তুলের হাটটিরও একই অবস্থা। উত্তরার দিয়া বাড়ির ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের বউ বাজার সংলগ্ন হাটটিও নির্ধারিত জায়গার বাইরে বসানো হয়েছে।
ডিএসসিসির উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘের খালি জায়গার হাটটি রেলওয়ে খেলার মাঠে বসানো হয়েছে। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পাশের নদীর পাড়ের হাটটি পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। দনিয়া কলেজের হাটটি কলেজ মাঠসহ শনির আখড়া পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত বসানো হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক স্ট্যান্ডের হাটটি রায়সাহেব বাজার মোড় হতে দয়াগঞ্জ মোড় পর্যন্ত একদিকে, আরেকদিকে মুরগিটোলা থেকে লোহারপুল পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে হাট ছাড়িয়ে গেছে। রহমতগঞ্জ ক্লাবের খালি জায়গার হাটটিও সড়ক আর খেলার মাঠে বসানো হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের হাটটি বেড়িবাঁধ এলাকার দুই-তিন কিলোমিটার জুড়ে বসানো হয়েছে। ইসলামবাগ ও হাজারীবাগে আবাসিক ভবনের সামনেও গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের পাশে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের স্থান নির্ধারিত হলেও হাটটি বালুর মাঠ ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠেও বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ধলপুর সিটি পল্লি মাঠ ও আশপাশের এলাকায়ও হাট বসানো হয়েছে। আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পাশের খালি জায়গার হাটটিও কলেজ মাঠসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে।
পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, হাট যেন তাদের জীবনে এক আতঙ্কের নাম। গরু, ট্রাক, মাইকিং, ময়লা, দুর্গন্ধ— সব মিলিয়ে এক অসহনীয় পরিবেশ।
রায়েরবাগ এলাকার বাসিন্দা হায়দার আলী বলেন, ‘দনিয়া কলেজ মাঠে হাটের অনুমতি দেওয়া হলেও গরু চলে এসেছে ৩ কিলোমিটার ভেতরে রায়েরবাগ পর্যন্ত। অলিগলি পর্যন্ত গরু। আমরা কোথায় যাব? কীভাবে চলব?’
দয়াগঞ্জের বি-ব্লকের বাসিন্দা রবিউল হক বলেন, ‘গলির মুখ থেকে মসজিদের পাশ পর্যন্ত গরু দাঁড়িয়ে আছে। এতে শিশু, রোগী ও পথচারীদের চলাফেরায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
শনির আখড়ার বাসিন্দা সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাস্তায় গরু দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মাইকে সারা দিন বিক্রি-বিক্রির চিৎকার। ঘরে বয়স্ক মানুষ, শিশুরা আছে—এমন পরিবেশে থাকা দায় হয়ে উঠেছে।’
এর বাইরে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ইজারা ছাড়াও অবৈধ গরুর হাট বসানো হয়েছে। ডিএসসিসির ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের কামরাঙ্গীরচরে এবার হাটের ইজারা দেয়নি করপোরেশন। তবে এ জায়গায় যুবদল নেতা সোহেল আরমান ও বিএনপি নেতা মনির চেয়ারম্যান মিলে অবৈধ গরুর হাট বসিয়েছেন। পরে হাজারীবাগের হাটের ইজারাদাররা হাটটি তুলে দেন। তবে কলাবাগান কলোনির মাঠে স্থানীয় বিএনপি আর এনসিপির নেতাকর্মীরা আরেকটি অবৈধ হাট বসিয়েছেন। হাতিরঝিল ঘেঁষে বাংলামটরে আরেকটি অবৈধ গরুর হাট বসছে। শ্যামপুরে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতির স্বল্পতা দেখিয়ে হাটের ইজারা নিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও সেখানে অবৈধ হাট বসানো হচ্ছে। বনশ্রী আর মেরাদিয়া এলাকায়ও চলছে অবৈধ হাটের প্রস্তুতি। এ ছাড়া মিরপুরের কাজীপাড়া বসুন্ধরা গলির পাশে আরেকটি পশুর হাট বসানো হয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের হাটের ইজারাদার নাফিস কবির বলেন, ‘কামরাঙ্গীচরের হাটটি আমরা আজ তুলে দিয়েছি; কিন্তু কলাবাগানে বিএনপি ও এনসিপির স্থানীয় নেতারা আরেকটি হাট বসিয়েছেন। এই অবৈধ হাটটি দ্রুত তুলে দিতে আমরা করপোরেশনের কাছে দাবি জানিয়েছি।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগেভাগে গরু আনার কারণ একটাই, ক্রেতাদের আগে থেকে দেখানোর সুযোগ তৈরি করা। এতে হাটে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ে, বিক্রির সম্ভাবনাও বাড়ে। যদিও তারা স্বীকার করেন, এখনো বিক্রির হার কম। ১ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকছেন। তবে মিলছে না ক্রেতা।
শনির আখড়া হাটের বিক্রেতা আজগর আলী বলেন, ‘১৫ লাখ দাম চাচ্ছি, এখন পর্যন্ত ৮ লাখ বলছে। দাম পেতে সময় লাগে। আগেভাগে এলে দরকষাকষির সময় পাওয়া যায়।’
কুষ্টিয়া থেকে শাহজাহানপুর হাটে আসা বিক্রেতা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘গ্রাম থেকেই কিনে এনেছি ৫ লাখের বেশি দামে, দাম বলছে ৩ লাখ ৬০ হাজার। তাহলে কীভাবে বিক্রি করব? রয়েছে খাবারের দাম ও ট্রাক ভাড়াও।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘নগরের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় হাট ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা জরুরি। প্রতি বছর একই বিশৃঙ্খলা দেখছি, অথচ কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এর পেছনে রয়েছে দুর্বল প্রশাসনিক সমন্বয়, রাজনৈতিক চাপ এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ। হাট ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। আবার যাদের ইজারা দেওয়া হয়, তারা নির্ধারিত নিয়ম মানে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নিয়ম অমান্য করে আগেই হাট বসিয়ে দেন। পরে প্রশাসন বাধ্য হয় বিষয়টি মেনে নিতে। এতে করে আইনের শাসন বিঘ্নিত হয়।’
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা হাসিবা খান কালবেলাকে বলেন, ‘ইজারাদারদের হাট বসানোর জায়গা নির্ধারণ করে শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও যে হাটগুলোর বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আর দনিয়া ও ধোলাইখালের হাট দুটির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
মন্তব্য করুন