রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০৮:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অস্বাভাবিক সংক্রমণ চিকুনগুনিয়ার

নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণের হার ৮২%
অস্বাভাবিক সংক্রমণ চিকুনগুনিয়ার

চলতি মৌসুমে আমাদের দেশে একই সঙ্গে কভিড-১৯সহ বিভিন্ন ফ্লু-ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে ঢাকা জেলায় দুজন ও বরিশালে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। শিশুদের পাশাপাশি এখন বড়দেরও আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। এ বছর ডেঙ্গু (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩) সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে। তবে কভিড-১৯, ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ার অস্বাভাবিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) প্যাথলজি ল্যাবের গত এক বছরের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া শনাক্তের হার ছিল ৫২ শতাংশ। ওই তিন মাসে ২৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে ১৪৯ জনের শরীরে রোগটি শনাক্ত হয়। এ বছরের জানুয়ারি মাসে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের হার ছিল ২৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কোনো নমুনা না এলেও এপ্রিলে শনাক্তের হার ২৯ শতাংশ, মে মাসে ৬৮ শতাংশ এবং জুনের ১ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত শনাক্তের হার ৮২ শতাংশ। এই ২১ দিনে ১৭১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৪০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে।

আাইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. শফিউল আলম বলেন, চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ একবার হলে বেশ কয়েক বছর পরে আবার সংক্রমণের প্রকোপ দেখা দেয়। আমরা গত ডিসেম্বরে বেশকিছু চিকুনগুনিয়ার রোগী শনাক্ত করি, সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর এর সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়। যাদের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে তাদের কারও ডেঙ্গু ছিল না। আইসিডিডিআর,বিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এ ধরনের পরীক্ষার সুবিধা সহজলভ্য নয়।

এদিকে, ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মে পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৩৭ জন সন্দেহভাজন চিকুনগুনিয়া রোগীর খবর পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে ১৫৩ জন রোগীর আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। সম্প্রতি প্রকাশিত আইইডিসিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সন্দেহভাজন এবং নিশ্চিত উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য চিকুনগুনিয়ার বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে, যা একাধিক শহরাঞ্চলে সংক্রমণ বাড়ার ইঙ্গিত বহন করে। আক্রান্ত এলাকাগুলো হলো—মহাখালী, তেজগাঁও, নাখালপাড়া, খিলক্ষেত, নিকেতন, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা, লালবাগ, আজিমপুর, হাজারীবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, খিলগাঁও, মুগদা, গোড়ান, রামপুরা ও শাহজাহানপুর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা দ্বারা সংক্রামিত এই সংক্রামোক রোগ হঠাৎ জ্বর, অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা, তীব্র মাথাব্যথা, পেশিব্যথা এবং ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে। চিকুনগুনিয়ার জন্য নিয়মিত জাতীয় নজরদারি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, সীমিত রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা এবং ডেঙ্গুর সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ওভারল্যাপের কারণে রোগটি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এডিস মশাই ডেঙ্গু ও জিকার মতো চিকুনগুনিয়ার বাহক হিসেবে কাজ করে। এই রোগে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কম হলেও শারীরিক যন্ত্রণা কম নয়। শরীরে ব্যথার তীব্রতা এতই বেশি হয় যে, অনেকে এটাকে ল্যাঙড়া জ্বরও বলে। চিকিৎসা অনেকটা ডেঙ্গুর মতোই। তবে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ২০০৮ সালে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে চিকুনগুনিয়ার প্রথম নিশ্চিত নির্ণয় করা হয়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৭ সালে দেশে একটি বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যা ঢাকাসহ ১৬টি জেলায় শনাক্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, এ সময়ে সাধারণ সর্দি-কাশিজনিত ভাইরাস ও কভিড-১৯ ভাইরাস একসঙ্গে হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যাকে অনেকে ফ্লুরোনা নামে অভিহিত করছেন। যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল তারা তীব্র কভিড-১৯ হওয়ার উচ্চঝুঁকিতে থাকবেন। বিশেষ করে অতিকায় স্থূলতা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হাঁপানি, ব্রস্কাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি, ক্রনিক কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত ব্যক্তি, যারা এই মুহূর্তে বিভিন্ন ক্যান্সারে ভুগছেন, বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সপ্লান্ট হওয়া রোগী, যারা এই সময়ে ডায়ালাইসিস পাচ্ছেন ইত্যাদি। এ ধরনের উচ্চঝুঁকি সম্পন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে এই সময়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে।

তিনি বলেন, উচ্চঝুঁকি সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই সময়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলবেন, বাইরে বের হলে সার্জিক্যাল মাস্ক পরিধান করবেন, হাঁচি-কাশি হলে রুমাল ব্যবহার করবেন, সাবান পানি দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে। সুষম খাবার ও বেশি বেশি পানি পান করতে হবে।

একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড প্রবন্ধে জানান, ডেঙ্গুজ্বরের হালকা উপসর্গে (৩-৫ দিন জ্বর, মাথাব্যথা, হালকা গায়ে ব্যথা) রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে (২৪ ঘণ্টায় ৩ গ্রামের বেশি না)। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। জ্বর কমার পর হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়া, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তপাত, ঘন ঘন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা মলিন চামড়া, অস্থিরতা, অজ্ঞানভাব, মাথা ঘোরানো—এই উপসর্গ দেখা গেলে এবং অন্তঃসত্ত্বাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। স্টেরয়েড (যেমন ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকরটিসন) ব্যবহার রোগীর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট বাড়াতে ঘরোয়া উপায় হিসেবে পেঁপে পাতার রস ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করছেন। তবে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এ ছাড়া ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে।

বিএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান তার ‘রিসেন্ট ট্রেন্ড ইন ফেব্রাইল ইলনেসেস ইন বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে জানান, চলমান বর্ষা মৌসুমে জুন-অক্টোবর হঠাৎ করেই জ্বরজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ভাইরাস জ্বর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও কভিড আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বরিশাল ও বরগুনায়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও পরিবর্তিত জলবায়ুর ধারা ডেঙ্গু সংক্রমণের মূল কারণ। চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮৭৭ জন। এবার (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩) সেরোটাইপ দিয়ে নতুনভাবে সংক্রমণ হচ্ছে।

এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৯৪ জন, যা চলতি বছরের এখন পর্যন্ত এক দিনের হিসাবে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি। এর আগে সোমবার ৩৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুলেটিনে বলেছে, নতুন আক্রান্তদের নিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগী বেড়ে দাঁড়াল ৮ হাজার ৫৪৪ জনে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে ১৫৭ জন, ঢাকার দুই সিটিতে ৯২ জন, ঢাকা বিভাগে ৩৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮ জন, খুলনা বিভাগে আটজন এবং রাজশাহী বিভাগে ৪৪ জন। ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ৮০ জন। এ বছর এটিই এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৩১০ জন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৭৭০ জন।

দেশে ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টিভিতে আজকের খেলা

চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

যুদ্ধ আমাদের ইমানি শক্তি বাড়িয়েছে : ইরানি আলেমদের প্রতিক্রিয়া

রাশিয়ায় ইরানি শিশুর সঙ্গে এ কেমন আচরণ, সারা বিশ্বে তোলপাড় (ভিডিও)

২৭ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ইরানকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের গোপন প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের

২৭ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মানববন্ধন আজ 

পরীক্ষার সুযোগ পেতে পারেন সেই ছাত্রী

সাতসকালে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের শিকার কালবেলার সাংবাদিক

১০

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১১

সুবর্ণচরে সাগরিকার সফল উদ্যোক্তাদের সম্মাননা প্রদান

১২

ইসরায়েলের হত্যা পরিকল্পনা থেকে যেভাবে বেঁচে গেলেন খামেনি

১৩

ফজরের পর যে গুরুত্বপূর্ণ আমল করবেন

১৪

গায়িকা কনার বিচ্ছেদ নিয়ে সালমার পোস্ট

১৫

ঢাবির মলচত্বরে গলায় ফাঁস দিয়ে হাসপাতালে তরুণী

১৬

ব্রিটিশ আমল থেকে ঢাকায় রথযাত্রার প্রচলন

১৭

অবিলম্বে পুশইনের ঘটনা বন্ধ করুন : লায়ন ফারুক

১৮

তারেক রহমানের ফেরার জন্য লন্ডন ও বাংলাদেশে প্রস্তুতি চলছে : এ্যানি

১৯

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন আবদুল আউয়াল মিন্টু

২০
X