একটি শিশু—যার জন্ম হয়েছিল এক ভাঙাচোরা পৃথিবীতে। জন্মের আগেই হারিয়েছে বাবাকে। যে মানুষটি তার জন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভবিষ্যতের ছবি এঁকেছিলেন, তাকে কখনো দেখেনি শিশুটি। এই দুনিয়ায় চোখ মেললেও বাবার মুখ দেখা হয়নি একবারও। আজও তার মুখে নিষ্পাপ হাসি; কিন্তু সেই হাসির গভীরে জমে আছে এক অপূর্ণ শূন্যতা—বাবার কোলে মাথা রাখার সুযোগ সে আর কোনোদিনই পাবে না।
তার বাবা মিনারুল ইসলাম—রাজশাহীর গুড়িপাড়ার পুরাপাড়ার বাসিন্দা, এক সংগ্রামী তরুণ। জীবন শুরু করেছিলেন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। ছোটবেলায় বাবাকে হারান, বড় দুই ভাই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক আর তিনি নিজে কাজ করতেন ঢাকার এক পোশাক কারখানায়। পরিবার ও ভবিষ্যতের জন্য তিল তিল করে গড়ে তুলছিলেন এক স্বপ্ন। আট বছর পর বাবা হওয়ার সম্ভাবনায় আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন মিনারুল; কিন্তু সে আনন্দ স্থায়ী হয়নি।
গত বছরের ২০ জুলাই, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মাত্র ২৭ বছর বয়সী এ শ্রমিক। স্ত্রী নূরেসান খাতুন শম্পা তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর দুই মাস ৯ দিন পর, এক বৃষ্টিভেজা সকালে তার কোলজুড়ে আসে পুত্রসন্তান। স্বামীর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ছেলের নাম রেখেছেন মিনহাজুল ইসলাম সাইফান। এখন তার বয়স ৯ মাস। সে এখনো বোঝে না কিছুই, জানে না বাবার আদর কেমন, জানে না বাবার কণ্ঠের সুর।
পরদিন মরদেহ বাড়িতে আসার পর শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবার। কিন্তু সেই শোকও যেন চেপে রাখতে বাধ্য করা হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে পরিবারকে বলা হয়, ‘মিনারুল গুলিতে মারা গেছেন’—এ কথা বলা যাবে না। মৃত্যু সনদে লেখা হয় ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। লাশ দ্রুত দাফনের মাধ্যমে চাপা দেওয়া হয় এক তরুণের রক্তে লেখা সত্যি।
তবে আওয়ামী সরকারের পতনের পর সাহস ফিরে পায় পরিবার। ৩ সেপ্টেম্বর মিনারুলের ভাই নাজমুল হক সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় ৯ মে গ্রেপ্তার হন নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
সম্প্রতি ফরাদপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় নূরেসান খাতুনের সঙ্গে। কোলে ঘুমন্ত সাইফান—মায়াজড়ানো এক মুখ, কিন্তু মায়ের চোখে লুকানো হাহাকার। নূরেসান বলেন, ‘বাবা থাকলে আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎটা আরও সুন্দর হতো। এখন ওই ছেলেটাকেই আমার পৃথিবী বানাতে চাই; কিন্তু আমাদের সামর্থ্য নেই। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই, যেন ও মানুষ হতে পারে।’
চোখের জল লুকাতে না পেরে আরও বলেন, ‘আর আমি চাই—আমার স্বামীকে যারা এভাবে গুলি করে মেরেছে, তাদের বিচার হোক। সে বিচার যেন আর দেরি না হয়।’
নূরেসানের বাবা মো. সাইদুল একজন দিনমজুর। তিনি বলেন, ‘আমার নাতি সাইফান অনেক সময় অসুস্থ থাকে। যা পারি করি; কিন্তু সব সময় চিকিৎসা দিতে পারি না। ওর বাবার মতো যেন আর কাউকে এভাবে মরতে না হয়—এইটাই চাই।’
একটি শিশুর অপূর্ণতা আজ দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়—এ ভবিষ্যৎ কি শুধু ওই মায়ের একার দায়িত্ব? নাকি আমাদের সবার?
মন্তব্য করুন