সুদীর্ঘ ১৩৮ বছরের পথচলার সবচেয়ে কঠিন সময়েও অনন্য এক বছর পার করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। দেশের অর্থনীতির স্বর্ণদ্বারখ্যাত এই বন্দর দেশীয়-আন্তর্জাতিক সংকটময় পরিস্থিতিতেও কার্গো-কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আয়, মুনাফাসহ সরকারি কোষাগারে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব জমা দিয়ে ধরে রেখেছে অগ্রযাত্রা। এই এক বছরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেও বন্দরের আধুনিকায়ন, দ্রুত জাহাজ বার্থিং এবং জনবল নিয়োগসহ প্রযুক্তির ব্যবহার আগামীদিনে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক বন্দর হিসেবে রূপান্তরের ভিত রচনা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে জাতীয় অস্থিরতা এবং ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ঝুঁকিতে পড়ে যায় চট্টগ্রাম বন্দর। সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এলে দ্রুত সংকট কাটিয়ে আন্তর্জাতিক এই বন্দরের কার্যক্রমে স্বাভাবিক গতি ফেরানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। অবশ্য গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি খাতে অস্থিরতা বিরাজ করলেও দেশের অর্থনীতি ও বন্দর প্রশ্নে সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্যে কোনো সংকট দেখা যায়নি। যার ফল হিসেবে টানাপোড়েনের এই সময়েও রেকর্ড পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং, রাজস্ব আয় ও সরকারি কোষাগারে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের খেতাব ধরে রাখে চবক। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের নেতৃত্ব এবং কৌশলগত ও গতিশীল পদক্ষেপে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় ফেরে স্থিতিশীলতা। অক্ষত থাকে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। সব মিলিয়ে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গত এক বছরে বন্দরের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং চবকের বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৮ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউ (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার ১ টিইইউ) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে চবক, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ দেশীয় সংকটকালীন বছরের কয়েক মাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট সবকিছু অনেকটাই স্থবির থাকলেও চবক ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৭ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেশি করেছে। এই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং মোট কার্গো থ্রুপুটে (একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো বন্দর বা টার্মিনাল দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা হয় তার পরিমাণ) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চবকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ব্যবসায়ী ও বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বন্যা, পরিবহন ধর্মঘট, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং দেশীয় শিল্প খাতের নিম্নমুখী প্রেক্ষাপটেও প্রশাসনিকভাবে অপারেশনাল (পরিচালনা) দক্ষতা দেখিয়েছে চবক। এই সময়ে জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ কাল কমে নেমে এসেছে মাত্র এক দিনে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে একটি বন্দরে জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ সময়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট দেশের বন্দরের মান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর সুবর্ণ সময় পার করছে বলে মনে করছেন তারা।
অস্থিতিশীল সময়েও চবকের অব্যাহত অগ্রযাত্রার প্রমাণ মেলে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় ও মুনাফা প্রবৃদ্ধির চিত্রে। সর্বশেষ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৫ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছর (২০২৩-২৪) থেকে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। বার্ষিক অপারেশনাল খরচ বাদ দিয়ে ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বন্দরের ২ হাজার ৯১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকার রাজস্ব উদ্বৃত্ত রয়েছে। বিগত ৫ বছরে বন্দর সরকারি কোষাগারে সর্বমোট ৭ হাজার ২০৩ কোটি ৬ লাখ টাকা জমা দিয়েছে। যার মধ্যে শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জমা দিয়েছে ১ হাজার ৭৬৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা গত পাঁচ বছরে জমা দেওয়া রাজস্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
দেশের সরকারি-আধাসরকারি দপ্তরগুলোয় জনবল সংকট ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয় না। তবে এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। গত এক বছরের সংকটময় সময়েও একসঙ্গে ৩৬৫টি শূন্য পদে নিয়োগ দেয় চবক। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা দূর করে ৬৬৩টি কর্মচারী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই সময়ে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াও বিশ্বমানের নিজস্ব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় চবক। বন্দরের নিবিড় ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে এই ইনস্টিটিউট থেকে দেশীয় অপারেটর ও কারিগরি কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানের মতোই দক্ষ করে তোলা হবে।
চবক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হাব। দেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া হিসেবে বন্দরকে ঢেলে সাজাতে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি সময়মতো কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। বিগত এক বছরের প্রতিকূল পরিবেশেও অপারেশনাল কার্যক্রমে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের উন্নয়নে যুগান্তকারী বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম বন্দর স্বাভাবিক গতিতেই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বন্দরের তালিকার দিকে এগিয়ে যাবে।’
বন্দরের কার্যক্রম শুধু পণ্য পরিবহন ও রাজস্ব আয়ে সীমাবদ্ধ নেই জানিয়ে চবক চেয়ারম্যান বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা-চিকিৎসা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বন্দরকে সময়ের পরিক্রমায় আরও বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ করা হচ্ছে। আগের বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর নানা সংকট নিরসন করে দ্রুত কাজ শুরুর চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে চবক। গত এক বছরে বন্দরকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজও চলছে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্য হ্যান্ডলিং ও রাজস্ব আয়ে রেকর্ডের পাশাপাশি বিদ্যমান দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের কাজ করেছে চবক। অটোমেশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ই-গেট পাস ও অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু এবং নতুন ক্রেন সংগ্রহ ছাড়াও ড্রাফটের গভীরতা (জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে) বৃদ্ধি করায় ৬০-৬৫ শতাংশ জাহাজ এখন বন্দরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বার্থিং করতে পারছে (টার্মিনালে নোঙর বা ভিড়তে পারা)। অনলাইন এজেন্ট ডেস্ক চালুর ফলে ঝামেলামুক্ত ডকুমেন্টেশন গ্রাহকসেবা সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। আধুনিক টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (টিওএস) যুক্ত করা হয়েছে অনলাইন গেট পাসের সঙ্গে। নতুন এই পদ্ধতিতে পরিবহন চালকরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রবেশ ফি পরিশোধ করে কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে দ্রত ই-গেট প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে ব্যবসায়ীরা কার্গোর রিয়েল টাইম ট্র্যাকিং (কার্গো কোথায় আছে, তাৎক্ষণিক তার সর্বশেষ অবস্থান জানা) সুবিধা পাচ্ছেন। যানবাহন ট্র্যাকিং ও স্বয়ংক্রিয় বার্থ বরাদ্দ পদ্ধতি বন্দরের কার্গো ব্যবস্থাপনায় এনেছে স্বচ্ছতা। মেরিটাইম সিঙ্গেল উইন্ডো চালুর ফলে বাণিজ্য ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইওআরআইএস প্ল্যাটফর্মে চবকের সংযুক্তির মাধ্যমে এফএএল কনভেনশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রোটোকলের সঙ্গে বন্দর কার্যক্রমের সামঞ্জস্য দিন দিন বাড়ছে।
নতুন উদ্যোগের পাশাপাশি বন্দরকে আরও বেশি গতিশীল করতে চলছে কৌশলগত পুনর্গঠন ও মাস্টার প্ল্যানের কাজ। বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরে বে-টার্মিনাল নির্মাণ, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সরকার মেরিটাইম সিঙ্গেল উইন্ডো প্ল্যাটফর্ম ধারণার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোকে একীভূত করে একটি সমন্বিত জাতীয় সমুদ্রবন্দর কৌশল প্রণয়নের কাজ করছে। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর ও বন্দর কর্তৃপক্ষকে রাখা হয়েছে কেন্দ্রে। বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নে জলবায়ু সহনশীল ব্রেকওয়াটার ও ড্রেজিংকৃত অ্যাক্সেস চ্যানেল ব্যবহার করে অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সক্ষমতা বাড়াতে এপিএম টার্মিনাল, ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ সিঙ্গাপুর ও জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রম গড়ে তুলেছে চবক। পাশাপাশি থাইল্যান্ডের রানং বন্দর ও ক্রোয়েশিয়ার রেজিকা গেটওয়ে চবকের সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে নতুন শিপিং রুট ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কোস্টগার্ড পরিচালিত নিরীক্ষায় এই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য আসেনি। নিরীক্ষা টিম আইএসপিএস মনিটরিং সেল, সিসিটিভি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম, রপ্তানি কনটেইনার স্ক্যানার এবং ইস্পাহানি-সামিট অ্যালায়েন্স ও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে।
মন্তব্য করুন