রাজধানীতে মেট্রোরেলের নতুন দুটি লাইনের নির্মাণকাজে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সেপ্টেম্বরে দেওয়া প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এমআরটি লাইন-১-এর কাজকে মোট ১২টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ভাগের কিঞ্চিৎ অগ্রগতি আছে, বাকিগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এসব বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ গত ছয় মাস ধরে এগোচ্ছে না। আর এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর)-এ মোট ১০টি প্যাকেজ রয়েছে। লাইন-১-এর তুলনায় লাইন-৫-এর অগ্রগতি কিছুটা ভালো। তবে তা আশানুরূপ নয়। এমন পরিস্থিতিতে কাজের ধীরগতি নিয়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি জাপান দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারকে এ নিয়ে চিঠিও দিয়েছে। সেই চিঠিতে ‘জরুরি’ ভিত্তিতে কাজের গতি বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়।
এমআরটি লাইন-১-এ প্রায় ৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পে ১২টি পাতাল স্টেশন ও ৭টি উড়াল স্টেশন নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতাল লাইন এবং নতুনবাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত উড়াল লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। আর এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর) এর আওতায় হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন নির্মাণের কাজ ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করা কথা। এই পথে পাতাল রেলের দৈর্ঘ্য হওয়ার কথা সাড়ে ১৩ কিলোমিটার। বাকিটা উড়াল অংশ। মোট ১৪টি স্টেশনের মধ্যে পাতালে থাকবে ৯টি এবং ৫টি থাকবে উড়াল পথে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাপানের ঋণে মেট্রোরেলের নতুন এই দুই লাইনের নির্মাণকাজ চললেও সরকার এখন চাচ্ছে, ঋণ চুক্তিতে সংশোধন আনতে। কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং সরকার এখানে খরচ কমাতে চায়। সে লক্ষ্যে নতুন করে কাজের দর নির্ধারণে জাপানের সঙ্গে আলোচনা চালানো হচ্ছে। আর আলোচনা শেষ না করে জাপানের কাছ থেকে নতুন করে ঋণ নিতে চাইছে না সরকার। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প অর্থায়নেরও খোঁজ চলছে। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে সরকার কথা বলেছে। সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় কি না, তাও ভাবা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, সরকার আসলে মেট্রোরেলের নতুন এই দুই লাইন নির্মাণে জাপানকে বাদ দিয়ে চীনা বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকতে চাচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি কেউ।
কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এমআরটি লাইন-১ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও লাইন-৫ (উত্তর)-এর প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাব হোসেন খানও। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। কাজ বন্ধ হয়নি, এতটুকু বলতে পারি। তবে আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। সরকারের দিক থেকে আমাদের কাছে কোনো মেসেজ নেই। কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জাপানকে সরিয়ে দেওয়া হবে—এগুলো শুধু আপনাদের (সংবাদমাধ্যম) কাছ থেকেই শুনি। জাপান অ্যাম্বাসাডর (রাষ্ট্রদূত) চিঠি দিয়েছেন শুনেছি। কিন্তু কেন দিয়েছেন এটির জবাব আমার দেওয়া সম্ভব নয়।’
জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘এখন এটা ইভালুয়েশন পর্যায়ে আছে বলা যায়। তাই কাজ তেমন একটা হচ্ছে না। জাইকার কাছ থেকে নতুন করে ঋণ নেব কি না, সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে। বিকল্প অর্থায়নও খোঁজা হচ্ছে। এত বড় ফরেন লোন…দামের চেয়ে বেশি এটা অ্যাফোর্ড করতে পারবো কি না। নতুন করে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে ভাবা দরকার, পরের সরকারের জন্য কতটা চাপ রেখে যাব। মেট্রোর কাজ জাপান বাস্তবায়ন করলেও আমাদের অসুবিধা নেই। আমাদের ভাবনা খরচ। প্রাইস নেগোসিয়েশনে (দর কষাকষি) রি-ইভালুয়েট (পুনঃবিবেচনা) করলে হয়।’
এদিকে কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ না হওয়ায় গতি বাড়াতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে চিঠি দেয় বাংলাদেশে অবস্থিত জাপান দূতাবাস। জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি স্বাক্ষরিত সেই চিঠিটি প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, অর্থ উপদেষ্টা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টাসহ আরও কয়েকটি দপ্তরেও পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা মেট্রো এমআরটি লাইন-১ ও লাইন-৫ (উত্তর) প্রকল্পগুলো জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রধান উদ্যোগ। জাপান এ প্রকল্পগুলো সময়মতো সফলভাবে শেষ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। জাইকার সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-১ বিশ্বব্যাপী তুলনামূলক প্রকল্পগুলোর মতো আর্থিকভাবে কার্যকর রয়েছে। প্রকল্পে যে ব্যয় বেড়েছে, তা যুক্তিসংগত। মূলত মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রয়োজনীয় নকশা সমন্বয়ের মতো বস্তুনিষ্ঠ কারণগুলো ব্যয় বাড়ার জন্য দায়ী।
চিঠির বিষয়ে মেট্রোরেল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ কালবেলাকে বলেন, ‘ডিপ্লোমেসিতে কে কাকে কতটুকু লিখতে পারে, সেটা আগে আমাদের জানা বোঝা দরকার—আমি চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখতে পারি কি না? দেশের জন্য যেটা ভালো হবে সেটাই করা হবে। এখানে আমরা কোনো দেশের নাম উল্লেখ করছি না। কাউকে বাদ দেওয়ার ইচ্ছা নেই। ইনক্লুড (যুক্ত) করার ইচ্ছেও নেই। মেট্রো আমাদের করতেই হবে। এখন লক্ষ্য—যত কম খরচে করা যায়।’
জাপানের ঋণে মেট্রো হচ্ছে, যেখানে ঋণচুক্তিতে ঠিকাদার নিয়োগ সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে জাইকার ঋণ নিয়ে আবারও দরপত্র আহ্বানের সুযোগ আছে কি না বা নতুন দরপত্র আহ্বানের চিন্তা করছেন কি না—জানতে চাইলে ফারুখ আহামেদ বলেন, ‘রি-টেন্ডারের কথা আমি এখনই বলছি না। আমাদের লক্ষ্য খরচ কমানো। এতে যা হওয়ার তাই হবে। আর নেগোসিয়েশনের (আলোচনা) সুযোগ সবসময় থাকে। বাকিটা সময় বলে দেবে।’
পুরো বিষয়টি অবগত করে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক ইস্যু। জাপান যে খরচ বেশি নিচ্ছে, এটা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়—এমন কোনো তথ্য ডিএমটিসিএল দেয়নি। খরচ বেশি মনে হলে সেটা নিয়ে বিভিন্ন প্যাকেজে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সেই আলোচনা নিষ্পত্তি না করে বিকল্প অর্থায়ন খুঁজলে সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এতে মনে করা যেতেই পারে সরকার কৌশলে জাপান থেকে বের হতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে জাপান থেকে বের হয়ে আসলে ব্যয় কমবে সেই নিশ্চয়তাও সরকারকে দেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের পিপিপি মডেলের অভিজ্ঞতা খুবই বাজে। মেট্রোরেলের নতুন দুই লাইন নির্মাণে পিপিতে ঝোঁকার অর্থ হচ্ছে, সেখানে চীনের বিনিয়োগ হলেও হতে পারে। তবে পিপিপি হোক বা না হোক, জাপানের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিল করে নতুন অর্থায়নের দিকে ঝুঁকলে সেক্ষেত্রে কাজ ভয়ংকর রকম পেছাবে। কারণ, নতুন যারাই অর্থায়ন করবে তারাই ফিজিবিলিটি স্টাডি থেকে শুরু সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করবে।
মন্তব্য করুন