

গোসাইরহাটের কোদালপুর বাজার থেকে সকালে বেরিয়ে ইদিলপুর ইউনিয়নের চর জুশিরগাঁও শ্রী শ্রী সার্বজনীন কালীমন্দির পর্যন্ত পথ মাত্র ১৩ কিলোমিটার। পথে পথে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত মিয়া নুরুদ্দিন অপুর গাড়িবহর এতটুকু রাস্তা পাড়ি দিয়ে ওই মন্দিরে যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। সেখানে সনাতন ধর্মের শ চারেক নারী-পুরুষ আপন মমতায় বরণ করে নিলেন মিয়া অপুকে। যেন বহু বছর পর সন্তান এসেছে বাড়িতে।
ওই মন্দিরের মতো গোটা পথেই হাজার হাজার মানুষ কেউ হাত নেড়ে, কেউ বুকে টেনে নিয়ে, কেউবা আবার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ আর দোয়ায় আপন করে নিলেন নুরুদ্দিন অপুকে। গোসাইরহাটের লোকজন তাকে বুঝিয়ে দিলেন, ‘তুমি আমাদেরই সন্তান’, সামনে ‘সফলতার সিঁড়িতে আমরাই টেনে তুলব তোমাকে।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক একান্ত সচিব (এপিএস) মিয়া নুরুদ্দিন আহাম্মেদ অপুর বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের কোদালপুর এলাকায়। তিনি এবার শরীয়তপুর-৩ (ডামুড্যা-গোসাইরহাট ও ভেদরগঞ্জের আংশিক) আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। গত বৃহস্পতিবার থেকে তিনি এই তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দিনে-রাতে জনসংযোগ, পথসভা আর মতবিনিময় সভা করে চলেছেন। গতকাল রোববার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজ এলাকা গোসাইরহাটের বিভিন্ন হাট-বাজার ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরেন। দল-মত, ধর্মের নির্বিশেষ মানুষ তাকে আপন করে নিচ্ছেন।
গতকাল গোসাইরহাটের নানা পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এলাকার সন্তানকে প্রার্থী হিসেবে পেয়ে তারা উচ্ছ্বসিত। এই মানুষগুলো যেন ‘রক্তের ঋণ’ শোধ করতে চাইছেন। সেই ঋণ কী, তা জানতে দুপুরে নুরুদ্দিন অপুর জনসংযোগের ফাঁকে ইদিলপুর বাজারে কথা হয় ৭০ বছর বয়সী বাদল সরদারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০১৮ সালে নুরুদ্দিন অপু ভালোবাসার টানে এলাকায় এসেছিলেন গণসংযোগে। ওই সময় তাকে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে রক্ত ঝরায়। তখন গোসাইরহাটের মানুষ চোখের সামনে এই নৃশংসতা দেখলেও আতঙ্কে মুখ খুলতে পারেনি। এবার তারা অপুকে ধানের শীষে ভোট দিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে চান।
গোসাইরহাটের মোল্লাপাড়া এলাকায় এক বাড়িতে কথা হয় নাসিমা বেগম নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, তারা এবার দল বা মার্কা বোঝেন না। এলাকার সন্তান অপু এমপি প্রার্থী হবেন। সব দলের লোকই তাকে ভোট দেবে। তার জন্য সবাই কাজ করছেন।
বাদল সরদার ও নাসিমা বেগমের কথার আভাস মেলে জনসংযোগে থাকা অপুর গাড়িবহরে ঢুকলে। কর্মসূচিগুলোতে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও শত শত সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছেন। তাদের অনেকেই নারী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে দিয়ে গাড়িবহর যাওয়ার সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাঁড়িয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তিনিও গাড়ি থেকে নেমে জড়িয়ে ধরছেন শিক্ষার্থীদের, কোলে তুলে নিচ্ছেন। কেউ মোবাইল ফোনে সেলফি তুলতে চাইলে নিজেই তা করে দিচ্ছেন।
গতকাল সকালে তিনি গোসাইরহাট বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘ইংলিশ একাডেমি’ নামে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সামনের সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় একদল শিক্ষার্থী তাকে ঘিরে ধরে। তাদের বায়না মেটাতে তিনি চলে যান স্কুলের ভেতর। ক্লাস শেষ করে তিনি শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খেলা জুড়ে দেন। বলেন, ‘আমার নাম অপু, আমি তোমাদের অপু ভাই। আমি সব সময় তোমাদের সঙ্গে থাকব। তবে তোমাদের ঠিকঠাক পড়ালেখা করতে হবে।’
নুরুদ্দিন অপু সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতেই আরেক দল শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিনি সরকারি শামসুর রহমান কলেজে যান। সেখানে তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছি। পড়ালেখা করার সময় অন্যকিছু করিনি, খেলাধুলা করেছি। এভাবে আমি তোমাদের ‘অপু ভাই’ হতে পেরেছি। তোমরা আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে, দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হতে হবে। এজন্য সবার আগে পড়ালেখা করতে হবে।
সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষ মুখিয়ে আছে। সবাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরতে মুখিয়ে রয়েছেন। তিনি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। শিগগির দেশে ফিরবেন।
পৌরসভা এলাকা থেকে ইদিলপুর ইউনিয়ন এলাকায় যান অপু। সেখানে তিনি বাজারে ব্যাপক জনসংযোগ চালান। ক্ষুদ্র দোকানি থেকে বড় ব্যবসায়ী—সবার সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন। পরে ইদিলপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা, হাসপাতাল রোড হয়ে প্রেস ক্লাব মোড় এলাকা, ধীপুর নয়াবাজার ও কালিখোলা মোড় এলাকায় জনসংযোগ চালান। সামন্তসার ইউনিয়ন এলাকায় বিভিন্ন বাজারে জনসংযোগ চালিয়ে তিনি সামন্তসার উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
ইদিলপুরের চর জুশিরগাঁও শ্রী শ্রী সার্বজনীন কালীমন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় নুরুদ্দিন অপু বলেন, ‘আমি আপনাদের সন্তান। তাই সন্তান হিসেবেই আমি সব সময় পাশে থাকব আপনাদের। আপনাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট তা এই সন্তানেরও।’ যে কোনো সমস্যায় তাকে সরাসরি অবহিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আপনাদের আপনজন। তাই আপনাদের সমস্যা আমারও সমস্যা। সন্তান হিসেবে চাইব না যে, আপনারা কোনো কষ্টে থাকেন।
বিকেলে মিয়া নুরুদ্দিন অপু নাগেরপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে তিনি নাগেরপাড়া বাজারে দোকানে দোকানে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। গতকাল রোববার নাগেরপাড়া হাটের দিন থাকায় সেখানে ক্রেতারাও ভিড় করেন। তারা নিজ এলাকার সন্তান অপুকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন।
ওই হাটে কালিখোলা মোড় এলাকা থেকে এসেছিলেন আকবর আলী। তিনি বলেন, ‘অপু সাহেব এলাকায় আসার পর মানুষ আশায় বুক বাঁধছে। এখন এলাকার উন্নয়ন হবে, সবাই শান্তিতে থাকতে পারবে। এজন্য নির্বাচনে এলাকাবাসীই তার হয়ে দায়িত্ব পালন করবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, মিয়া নুরুদ্দিন অপু এলাকায় জনসংযোগ শুরুর পর গোটা জেলাতেই একটা জাগরণ ঘটেছে। দলীয় নেতাকর্মীরা যেভাবে উৎফুল্ল হয়েছেন, তেমনি পিছিয়ে পড়া সাধারণ মানুষও উন্নয়নের প্রত্যাশায় রয়েছেন।
মিয়া নুরুদ্দিন অপুর কণ্ঠেও মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি মিলল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই ঘনিষ্ঠজন জানালেন, গত চার দিন ধরে শরীয়তপুর-৩ আসনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তার মনে হয়েছে, এই এলাকার মানুষ বছরের পর বছর ধরে একটি দলকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু শরীয়তপুরের মানুষ অবহেলাতেই থেকেছে, উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই সুযোগ পেলে তিনি শরীয়তপুরকে মডেল জেলা বানাবেন।
তিনি বলেন, সবকিছুর পেছনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা। তাই তিনি পুরো এলাকায় শান্তি ফেরাবেন। সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ বন্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন। তরুণদের নিয়ে মডেল শরীয়তপুর গড়ে তুলবেন।
জনসংযোগ, পথসভা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শরীয়তপুর জেলা, গোসাইরহাট উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কালবেলার শরীয়তপুর প্রতিনিধি ও ডামুড্যা প্রতিনিধি)
মন্তব্য করুন