

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। এখন নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করার কাজে হাত দিয়েছে দলটি। বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা, জুলাই জাতীয় সনদ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার সমন্বয়ে এবারের এ ইশতেহার গঠন হবে। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক নানা বক্তব্য মূল দিকনির্দেশনা হয়ে প্রতিফলিত হবে ইশতেহারে। এদিকে আসন্ন নির্বাচনে শ্রেণিভিত্তিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রচারে নামবে বিএনপি। গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
জানা গেছে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালীকরণ ইশতেহারের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলাই হবে বিএনপির অঙ্গীকার।
ইশতেহারে বিএনপির ৩১ দফার মূল বিষয়—অবাধ নির্বাচন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সুরক্ষা, বাকস্বাধীনতা, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার—বিশদভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ছাড়া জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা দেওয়ার পরিকল্পনাও ইশতেহারে গুরুত্ব পাবে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলীয় প্রচারের কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে কী কী বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে নেতারা মতামত দেন। কৌশল অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাকে আলাদাভাবে টার্গেট করবে বিএনপি। এ তালিকায় আলেম-ওলামা, হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যুবক, কৃষক, নারী ও সিনিয়র সিটিজেন রয়েছে।
জানা গেছে, দলটির ইশতেহারে কওমি মাদ্রাসা উন্নয়ন, ইসলামিক গবেষণা তহবিল গঠন, ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকায়ন ও ধর্মচর্চার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকবে। সাম্প্রতিক এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, আলেম-ওলামার সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; তারা জাতীয় ঐক্যের অংশীদার।
ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল রোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, নিরাপত্তা সেল, উৎসবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা এবং সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে কঠোর কার্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি যুক্ত হবে। তারেক রহমান সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে রাষ্ট্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিএনপি যুব সমাজকে টার্গেট করে বড় পরিসরে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি যুক্ত করছে ইশতেহারে। এর মধ্যে রয়েছে—১ কোটি নতুন চাকরি, স্টার্টআপ ফান্ড, আইটি প্রশিক্ষণ, বিদেশে নতুন শ্রমবাজার ও মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স। তারেক রহমানের ভাষায়, নতুন বাংলাদেশ গড়বে যুব সমাজ; চাকরির সংকট নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে বৈশ্বিক সুযোগ সৃষ্টি করবে বিএনপি।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষককে গুরুত্ব দিয়ে ইশতেহার তৈরি করছে বিএনপি। এর মধ্যে কৃষি উপকরণের দাম কমানো, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, কৃষিঋণ সহজ করা এবং ধান-চাল কেনার স্বচ্ছ ব্যবস্থা। তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফসল বিক্রি করবে—এটা আর হবে না।
নারীর নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, নারী উদ্যোক্তা তহবিল, মাতৃত্বকালীন ভাতা বৃদ্ধি এবং সহিংসতা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল—এগুলোও ইশতেহারের অংশ হচ্ছে। ইশতেহারে ফ্যামিলি কার্ড, বয়স্ক ভাতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শক্তিশালী করার অঙ্গীকারও যুক্ত হবে।
লন্ডন থেকে ভিডিও বার্তা, ভার্চুয়াল আলোচনা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারেক রহমান নিয়মিতই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের কথা তুলে ধরছেন। তার বক্তব্যে দলীয় রাষ্ট্রের অবসান, গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ও জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা—এসব বিষয়ই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দলীয় সূত্র বলছে, এসব দিকই ইশতেহারের চূড়ান্ত ভাষায় প্রতিফলিত হবে। বিএনপি নেতারা আশা করছেন, ৩১ দফা, জুলাই সনদ ও টার্গেট গ্রুপভিত্তিক প্রতিশ্রুতি—এ তিনের সমন্বিত ইশতেহার তাদের নির্বাচনী প্রচারে নতুন গতি এনে দেবে।
দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্বাচনের তপশিলের পর একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইশতেহার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
মন্তব্য করুন