রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ জুন ২০২৩, ০১:১৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু দুর্ভোগ কমে না ঈদযাত্রায়

ঢাকা ছাড়বে দেড় কোটি মানুষ
পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

নিরাপদ ঈদযাত্রায় বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ম্লান হয় উৎসবের আমেজ। সড়ক ও নৌপথে সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ার উদাহরণ বেশি। রেলপথে সবচেয়ে বেশি ত্রুটি হলো টিকিট ছাড়া চলাচল ও ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ ঠেকাতে না পারার পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী টিকিট দিতে না পারা। আসন্ন ঈদুল আজহায় ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নিরাপদ করতে এরই মধ্যে ১৪টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। রেলপথ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বেশকিছু পরিকল্পনা। নৌ, হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। প্রতিবছরই এমন উদ্যোগ এবং নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তবে এসব উদ্যোগের পরও দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রার নজির একেবারেই কম।

এদিকে এসব সিদ্ধান্ত শতভাগ কার্যকর করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে যাত্রী অধিকার আদায়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। এজন্য ঈদের পরও সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের দুদিন আগে থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ রাজধানী ছেড়ে যান। কিন্তু নৌ, সড়ক ও রেলপথ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২২ লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। বাদবাকি ১৩ লাখ যাত্রী বিকল্প উপায়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। রাজধানী থেকে দিনে সড়কপথে সর্বোচ্চ ৮-১০, নৌপথে ৮-১০ ও রেলপথে দেড় লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে।

সব পক্ষই বলছে, ঈদে ঘরমুখো মানুষের পথের দুর্ভোগের বড় কারণ সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি অন্তত তিন দিন আগে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে গা-ছাড়া ভাব দেখা দেয়। দুর্ভোগ ও অনিয়মের প্রতিকার না পেয়ে অনেকের ভোগান্তি মাথায় নিয়ে নিজের মতো করে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় থাকে না। সেইসঙ্গে দেশের গণপরিবহন বাড়ানোর বিশেষ কোনো পরিকল্পনা না থাকায় বাড়ি ফেরার ঝক্কি থেকেই যাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা-বিআরটিসি ঈদ উপলক্ষে বাস সার্ভিস চালু করলেও সেবার মান ভালো না হওয়ায় সেখানে যাত্রী হয় না। অনেকেই জানেন না, বিআরটিসি বাস কোথা থেকে ছাড়ে। এজন্য বিভিন্ন বাস টার্মিনালের পাশে থেকে বিআরটিসির সেবা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ, যেন সাধারণ যাত্রীরা বেসকারি বাস না পেয়ে দ্রুত বিআরটিসি সেবা নিতে পারে।

নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঈদে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল ছেড়ে যায়। তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ (৩০ লাখ) যায় নৌপথে। এর প্রায় শতভাগই উপকূলীয় জেলা বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের যাত্রী।

যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এবারের ঈদে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ আশপাশের অঞ্চল থেকে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ সারা দেশে যাতায়াত করবেন।

ঈদুল আজহায় সড়ক-মহাসড়কের পাশে পশুর হাট যানজটের ভোগান্তির একটা বড় কারণ হতে পারে। তেমনি আসা-যাওয়ায় বাসের বাড়তি ভাড়া, লক্কড়-ঝক্কড় আনফিট যানবাহন চলাচল, চালকদের লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানোর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সিটি সার্ভিসগুলো আন্তঃজেলায় চলাচল, দাঁড়িয়ে ও ছাদে যাত্রী পরিবহন, পণ্যবাহী বাহনে যাত্রী নেওয়ার অভ্যাস একেবারেই বদলায়নি। যথাসময়ে সব সড়ক মেরামত না হওয়ায় বড় সমস্যাও রয়েছে। ঈদের আগের তিন দিনসহ ঈদের দিন ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধের নির্দেশনা মানার প্রবণতাও কম। যানবাহন সংকট তো আছেই। তেমনি পশুবাহী যানবাহন মহাসড়কে থামিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগও বিস্তর। দুর্ঘটনার পর দ্রুত সড়ক থেকে গাড়ি সরানো ও রেকারের ব্যবস্থা থাকা, পর্যাপ্ত পুলিশি নজরদারির সিদ্ধান্তও পুরোপুরি কার্যকর হয় না।

এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে এরই মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

সড়কপথে ভাড়া নৈরাজ্য রোধে পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হলেও তা একেবারেই ‘কাগুজে বাঘ’-এ রূপ নিয়েছে। আর ভাড়া নৈরাজ্য রোধে বিআরটিএ নামেমাত্র অভিযান পরিচালনা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। বেশি আয়ের জন্য চালকরা রাতদিন গাড়ি চালালেও তা দেখভাল করার কেউ থাকে না। তেমনি বেপরোয়া গাড়ি চালানোসহ নানা কারণে ঘটে দুর্ঘটনা।

সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ভিজিলেন্স টিম যাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়। তা ছাড়া ঈদের শেষ তিন দিনে এত বেশি যাত্রীর চাপ থাকায় ইচ্ছা থাকলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না।

এ প্রেক্ষাপটে ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলাচল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, গণপরিবহন সংকটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু পরিবহন মালিকরা প্রতিবছর ঈদে ফিটনেসবিহীন বাস ও লঞ্চ রং করে যাত্রী পরিবহনের জন্য নামায়। এসব যানবাহন মাঝপথে দুর্ঘটনায় পতিত হলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়া অতিরিক্ত মুনাফার লোভে একজন চালককে বিশ্রামহীনভাবে ১৫ ঘণ্টা বাস চালাতে বাধ্য করা হয়। অদক্ষ চালক দিয়ে আনফিট যানবাহন চালানোর কারণে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ঈদে কয়েকশ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০২২ সালে ঈদুল আজহায় ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন নিহত এবং ৭৭৪ জন আহত হয়েছিল। এবারও ঈদযাত্রার বহরে মোটরসাইকেল যুক্ত থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ হারে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, কিছু অতিলোভী পরিবহন মালিক অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ভাড়া নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে সরকার প্রতিবছর ঈদে ‘কাগুজে বাঘের’ মতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এবারের ঈদেও সব পথে দ্বিগুণ-তিনগুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য হতে পারে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, নিরাপদ ঈদযাত্রায় আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। সব বিভাগ সমান দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলে অনেকটা দুর্ভোগমুক্ত ঈদযাত্রা উপহার দেওয়া সম্ভব।

নৌপথে ঈদযাত্রায় বড় সমস্যা হলো অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই, সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকাসহ ফিটনেসবিহীন যান চালানো। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিবেচনায় না নিয়ে লঞ্চ চালানোর কারণেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া কেবিনের বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ এবারও আছে। বৃহত্তর বরিশালমুখী যাত্রীসংখ্যা কমলেও ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ গন্তব্যে যাবেন নৌপথে। এর মধ্যে ৩ লাখ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর হয়ে এবং বাকি ২৭ লাখ যাবেন সদরঘাটসহ ঢাকার বিভিন্ন নৌপথ হয়ে। তাই এবারও সদরঘাটের ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়বে।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ঈদে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে লঞ্চে যাবেন ২২ লাখ ৮৫ হাজার যাত্রী। এই হিসাবে সদরঘাট থেকে প্রতিদিন ৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৭ যাত্রী লঞ্চে চড়বেন। একটি লঞ্চে গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৬৪২ জন যাত্রী উঠবেন; কিন্তু কোনো লঞ্চেই ২ হাজারের বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা নেই। অনেক লঞ্চের ধারণক্ষমতা ১ হাজারেরও কম।

জানা যায়, কাগজে-কলমে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের নৌপথ ৪১টি। ১৫টি নৌপথ এরই মধ্যে পরিত্যক্ত। বাকি ২৬টি নৌপথে প্রায় ৭০টি লঞ্চ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। ঈদের আগে লঞ্চের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৮০ হবে।

সদরঘাট নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক কবির হোসেন বলেন, আমরা প্রতিবার চেষ্টা করি নিরাপদে যেন মানুষ বাড়ি ফিরতে পারেন। এজন্য নৌ পুলিশ, লঞ্চ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যাত্রী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতার বিকল্প নেই।

ঈদযাত্রায় সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় উল্লেখ করে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, মূলত আন্তরিকতার অভাবেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নির্বাচন বিলম্বিত হলে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হবে: সালাহউদ্দিন

ক্যারিবীয়দের উড়িয়ে তিন দিনেই ভারতের টেস্ট জয়

১৭১৫ সালে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে মিলল ১২ কোটি টাকার সোনা-রুপার মুদ্রা

বিদ্যুৎস্পর্শে প্রাণ গেল জামায়াত নেতার

নুরের দেশে আসার সময় জানালেন রাশেদ

মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে তরুণকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা

১০ বছর পর রোববার দেশে ফিরছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক রাশেদুল হক

এমপি প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা / ৬ দফা দাবিতে ২৪ দিনের কর্মসূচি খেলাফত মজলিসের

রোহিতকে সরিয়ে নতুন ওয়ানডে অধিনায়কের নাম ঘোষণা করল ভারত

স্ত্রী-শাশুড়ি মিলে যুবককে হত্যাচেষ্টা, ঘরের বারান্দায় খোঁড়া হয়েছিল কবর

১০

যে ৩ সময়ে আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে বেশি উপকার মিলে

১১

হরাইজন মডেল ইউনাইটেড নেশনস সেশন-১ : এক অনন্য সফলতা

১২

ছেলে হত্যার বিচার ঠেকাতে ষড়যন্ত্রমূলক নতুন মামলা, ক্ষোভে শহীদ ছায়াদের পরিবার

১৩

সেপ্টেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ মৃত্যু

১৪

সাধারণ যে ৬ ভুলের কারণে পারফিউমের ঘ্রাণ দ্রুত চলে যায়

১৫

বেনাপোল বন্দরে ৫ দিন পর আমদানি-রপ্তানি শুরু

১৬

হবিগঞ্জে নদী থেকে মাদ্রাসাছাত্রের মরদেহ উদ্ধার

১৭

আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি দেখতে চাই: জামায়াত আমির

১৮

কিয়ামতের দিন যে ৫ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কেউ রেহাই পাবে না

১৯

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ২০ দফায় কী আছে, কেন তুমুল আলোচনা

২০
X