গরমের তীব্রতায় হাঁসফাঁস অবস্থা সবার। বাতাসে ঝরছে আগুনের হল্কা, বৃষ্টির দেখা নেই। বাসা থেকে বের হলেই খরতাপে অসহনীয় অবস্থা। বর্তমানে অনেকটা মরুভূমির মতো গরম অনুভূত হচ্ছে। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিও খামখেয়ালি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ক্ষয়ক্ষতিও তীব্র হচ্ছে। ছয় ঋতুর কৃষিপ্রধান সবুজ দেশে মূলত গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত—এ তিন ঋতুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা আগের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। শীতকাল আরও বেশি শুষ্ক এবং বর্ষাকাল আরও বেশি আর্দ্র হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে আরও উত্তপ্ত অবস্থা তৈরি হতে পারে। অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাওয়া, বায়ুদূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বৈশ্বিক আবহাওয়ার নানা ধরনের পরিবর্তনের কারণে মরুভূমির মতো তাপ অনুভব হচ্ছে। পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ, জলাশয় রক্ষা ও বেশি করে গাছ লাগালে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাজশাহীতে উঠেছিল ১৯৭২ সালের ১৯ মে। এর আগে ১৯৫৬ সালের ১৬ এপ্রিল বরিশালে ৪৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৮৯ সালের ২১ এপ্রিল বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৬৩ সালের ২ এপ্রিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহে ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৯৬৬ সালের ১০ এপ্রিল রাঙামাটিতে ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল।
গত এপ্রিল-মে মাসের পুরোটা জুড়েই তাপপ্রবাহ, কালবৈশাখী, বজ্রপাতের দাপট ছিল। মে মাসের মাঝামাঝিতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তাপমাত্রা কিছুটা কমেছিল। এর কয়েকদিন পরই আবারও তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ৪ এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের, ১৩ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল তীব্র এবং ২৪ এপ্রিল ৩০ এপ্রিল মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। চলতি মৌসুমে ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর ১৭ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল ঈশ্বরদীতে, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তবে তাপমাত্রা যতটা দেখায়, গরমের বোধ তার চেয়ে ন্যূনতম কয়েক ডিগ্রি বেশি অনুভূত হয়।
কয়েক বছর ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ২৬ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রা হয়েছিল ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। গত রোববার স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখেছে উত্তরের জেলা দিনাজপুরে। ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা খুঁজতে গিয়ে আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা দেখতে পান, গত ৬৫ বছরে এত গরম আর অনুভূত হয়নি।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মকালে মরুভূমির মতো উত্তপ্ত আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় শুধু এপ্রিল মাসে এ ধরনের আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বড় শহরগুলোতেও একই প্রবণতা চোখে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালে দেশের পাঁচটি শহরের গ্রাম ও শহর এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য নিয়ে একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা গেছে, ঢাকার পার্শ্ববর্তী গ্রাম এলাকার সঙ্গে ঢাকার মূল শহরের তাপমাত্রার পার্থক্য সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ শহরের তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। মতিঝিল, গুলিস্তান ও ফার্মগেটের মতো এলাকার সঙ্গে গ্রামের তাপমাত্রার পার্থক্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি পাওয়া গেছে। মূলত কংক্রিটের স্থাপনা বেড়ে যাওয়া এবং জলাশয় ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়ার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেডক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে তিনটি সময়কালে ভাগ করা হয়েছে—ঠান্ডা ও শুষ্ক অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি, মার্চ থেকে মে গরমকাল এবং জুন থেকে অক্টোবর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময়।
আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের উষ্ণতা সর্বোচ্চ হতে পারে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে ডেতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা। ওয়ার্ল্ড মেটিওরজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) সম্প্রতি জানিয়েছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা এখন হুমকির মুখে। চলতি বছরসহ আগামী পাঁচ বছরে পৃথিবীতে যে গরম পড়বে, তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার দুই-তৃতীয়াংশ আশঙ্কা রয়েছে। এ হিসেবে ২০২৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত আগামী পাঁচ বছরই হতে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এল-নিনো তৈরির আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এল-নিনো আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক অবস্থান। এর ফলে আবহাওয়া গরম করে, লা-নিনা আবহাওয়া ঠান্ডা করে। ডব্লিউএমও জানিয়েছে, এল-নিনো তৈরি হলেও লা-নিনা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। এর প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য, খাদ্যভান্ডার এবং সার্বিকভাবে পরিবেশের ওপর। খড়া এবং বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। শস্য উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। সবাই যাতে এর জন্য তৈরি থাকে, সেই সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। এল-নিনো সক্রিয় অবস্থায় যাওয়া শুরু করায় এখানে আকাশ প্রায় মেঘমুক্ত। সুতরাং ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ধরে প্রখর সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পতিত হতে থাকে। এ কারণেই বাতাসের গতিবেগ কম, বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য বেশি। অস্বস্তিও বেশি। তবে এটা শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে, তা নয়। বাংলাদেশসহ আশপাশের সব অঞ্চলের তাপমাত্রাই এখন বেশি। এল-নিনো সক্রিয় হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশসহ ভারতের হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, আফগানিস্তান—এই পুরো অঞ্চল এখন হিট ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছে।
আরেক আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, এপ্রিল মাসে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যে গরম অনুভূত হয়নি, এখন ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তার চেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। জলীয়বাষ্পের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা একই থাকলেও গরমের পার্থক্য থাকে। সামনের দিনগুলোতেও গরমের তীব্রতা থাকতে পারে, কারণ, কয়েক বছর ধরেই আমরা আবহাওয়ার বৈরী অবস্থা দেখছি। আগে যেটা হয়নি যে, একটানা এতদিন তীব্র গরম। আগে যেটা হতো যে, তিন-চার দিন তীব্র গরম পড়লে আবার বৃষ্টি হতো, এরপর আবার হয়তো গরম পড়ত। সেই বিষয়গুলোর পরিবর্তন হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় পড়েছে। এখানে গ্রীষ্মকালে গরম থাকলেও বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, বিশেষ করে এ বছর দেশের বড় অংশের আবহাওয়া মরুভূমির মতো আচরণ করছে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.২৮ ডিগ্রি বেড়েছে। বাংলাদেশেও এরই রকম তাপমাত্রা বেড়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রভাবও রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান ও চীনের কিছু অংশে বেশি উষ্ণায়ন হচ্ছে। যে বাতাস জলীয়বাষ্প নিয়ে শীতল করার কথা, সেই বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে না বঙ্গোপসাগর থেকে। এ অঞ্চলে নদীর সংখ্যা, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কমে সে জায়গায় বালুময় অবস্থায় আছে। নদী কমলেও সেই জায়গা যদি সবুজ হতো, তাহলে এত উষ্ণায়ন হতো না। হিমালয়ের বরফ গলে সেখানে এখন কঠিন শিলা দেখা যাচ্ছে। এতে সূর্যের তাপমাত্রা কমে এবং পরবর্তী সময়ে দীর্ঘসময় তাপমাত্রা বেশি থাকছে।
ঢাকা শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নদী, জলাভূমি, গাছপালা ও উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে ১৫ লাখ ইঞ্জিনচলিত গাড়ি রয়েছে। এগুলোর ইঞ্জিন চলার সময় তাপমাত্রা বাড়ে। ইটভাটা ও শিল্পকারখানার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। কাঁচের তৈরি ভবন ও এসির ব্যবহারও তাপ ছড়াচ্ছে। এখনই যদি এসব দূষণের পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে তাপমাত্রা বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. দিলারা জাহিদ বলেন, গরম প্রতিবছরই বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন স্পষ্ট। আমাদের এলাকাগুলোতে ঠান্ডা রাখতে গাছপালা ও জলাশয় কমানো যাবে না। গাছপালা ও জলাশয় তাপ ধারণ করে। অতিরিক্ত এসির ব্যবহার, কলকারখানার দূষণও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানিয়েছেন, কোনো স্থানে তাপপ্রবাহের সৃষ্টি প্রাকৃতিক নিয়মে শুরু হলেও তাপপ্রবাহের তীব্রতা কম বা বেশি হওয়া নির্ভর করছে ওই স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের দ্বারা কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে, তার ওপর। একই তাপপ্রবাহ ঢাকা শহরের পাশে অবস্থিত আড়িয়াল বিল এলাকার কিংবা টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকার মানুষের জন্য যতটুকু অস্বস্তি সৃষ্টি করবে, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টদায়ক হবে ঢাকা শহরের মানুষের জন্য। কারণ, সূর্যতাপের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হবে আড়িয়াল বিল এলাকার জলাভূমির পানি বাষ্পায়ন করার জন্য কিংবা মধুপুর বনভূমির থেকে ইভাপোট্রান্সপিরেশনের (যার মাধ্যমে জল ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলে চলে যায়) জন্য। যে শহর এলাকায় খোলা জায়গা ও গাছপালা যত বেশি থাকবে, সেই শহরে এলাকার মানুষ তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব তত কম অনুভব করবে।
মন্তব্য করুন