আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের বর্তমান এমপি জাফর আলম। নিজের গড়ে তোলা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মারধরের হুমকি-ধমকি দিয়ে পুরো চকরিয়ায় ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তিনি। সর্বশেষ বুধবার তারই ইশারায় শীর্ষ ডাকাত ও ডজন মামলার আসামি নবী হোসেন বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। এতে অন্তত দশজন আহত হয়েছে। এর আগে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সালাহ উদ্দীন আহমদের আঙুল ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তার ছেলে তানভীর আহমদ সিদ্দিকী তুহিন। গত রোববার সন্ধ্যায় চকরিয়ার চিরিঙ্গায় দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও মতবিনিময় সভায় তিনি এ হুমকি দেন। তার বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, ‘এই সালাহ উদ্দীন, এই ব্যাটা, আমার বাপরে নিয়া অনেক কথা বলছস। আমরা ভদ্রতা দেখাইছি অনেক। আজ থেকে কোনো ভদ্রতা নেই। এখানে কেউ যদি আঙুল তুলে, সেই আঙুল আমরা ভেঙে দেব।’ তাই এই আসনে নির্বাচনী সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
স্থানীয়রা জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে কক্সবাজার-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন জাফর। প্রায় সব ইউনিয়নে ডাকাত, চোর, দখলবাজ এবং বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। এলাকায় এই বাহিনী জাফর গ্রুপ বা জাফর লীগ নামে পরিচিত। তার বাহিনীর সদস্যরা চিংড়ি ঘেরে ডাকাতি, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল, চাঁদাবাজি, পাহাড় কাটা, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করেন না। এমপি হওয়ার পর শতকোটি টাকা সম্পদ বেড়েছে জাফর ও তার পরিবারের সদস্যদের। নামে-বেনামে রয়েছে শতকোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। চকরিয়া ও পেকুয়া দুই উপজেলায় দুই শতাধিক জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল করেছেন বিভিন্নজনের নামে। হামলা মামলার ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলে না।
তবে এমপি জাফরসহ পরিবারের ৪ সদস্যের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ হলে গণমাধ্যম জানানো হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চকরিয়া পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ডে ভূমি অফিসের সামনে আনুমানিক দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ, চকরিয়া পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড গ্রিন ভ্যালির পাশে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের দুই একর জমি দখল করেন। পরে জমির মালিক তা বিক্রি করতে বাধ্য হন। জমিটি জাফর তার মেয়ে তানিয়া আফরিনের নামে কিনে নেন। চকরিয়া ফায়ার সার্ভিসের সামনে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে নিয়েছে তার বাহিনীর সদস্যরা। পৌরসভার চিরিংগায় সিস্টেম মার্কেট নামের একটি মার্কেটে শেয়ারহোল্ডার এবং এ ভবনের পাশে স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে ‘শাহেদা কমপ্লেক্স’ নির্মাণ করেছেন। এ মার্কেটের নিচে ছেলে তানবির হোসেন ছিদ্দিক তুহিনের এরিস্টোডাইন নামক রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেল এবং হৈ ছৈ কিডস জোন রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। তুহিনের দৃশ্যমান কোনো আয় না থাকলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। এ ছাড়া স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া অবস্থানকালে ২০ কোটির বেশি টাকা পাচার এবং মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
পৌর বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশের জলাশয় দখল ও ভরাট করে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রুপের কাছে বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে এমপি জাফরের বিরুদ্ধে। গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দকৃত রামপুর মৌজায় ৩০০ একর চিংড়ি প্রজেক্ট জামাল হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে রাতের অন্ধকারে জবরদখল করে নিয়েছেন। এ ছাড়াও তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকা অপরাধীরা পেকুয়া ও চকরিয়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকটি চিংড়িঘের, হাজার একর বনভূমি দখল বরইতলী-মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকার বিশাল পাহাড় কেটেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পেকুয়ায় ৪নং ইউনিয়ন পরিষদ দীঘির পাশে কুহলিয়া খাল ভরাট করে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে নিউমার্কেট নির্মাণ করছেন। এসব দখল ও চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধের নেতৃত্বে দেন তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ক্যাডার জিয়াবুল, মিজান, সুজন, লায়ন আলমগীর, আবু মুসা, নবী হোসেন, সাইফুর রহমান আদর।
স্থানীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, এমপি জাফরের মিথ্যা মামলায় ঘরছাড়া হয়েছেন দলের অর্ধশত নেতাকর্মী। তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তারা। পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক মো. আজমগীর বলেন, এখানকার ২৫ জনের জমি জোরপূর্বক দখল করে মেয়ে তানিয়া, বিএনপি নেতা ইসলাম সিকদার এবং মেহের আলীর নামে ভুয়া দলিল করে মার্কেট নির্মাণ করছেন। জাফরের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এসএম গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর, সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিনসহ অসংখ্য নেতাকর্মী।
মাতামুহুরি সাংগঠনিক ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিন বাবুল বলেন, গত ৭ নভেম্বর এমপি জাফরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত জিয়াবুল ও ভাগিনা মিজানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী আদালত প্রাঙ্গণে আমার ওপর হামলা চালায়। রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। এ অবস্থায় এলাকায় শান্তি ফেরাতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগকে গলা টিপে হত্যা করে জাফর লীগ সৃষ্টি করে চকরিয়া-পেকুয়ায় সন্ত্রাস ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এমপি জাফর। দলের শত শত নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করেছেন। বলতে গেলে তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে চকরিয়া-পেকুয়ার কয়েক লাখ মানুষ। তার কারণে দলের ভাবমূর্তি যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি ভোট ব্যাংক তলানিতে ঠেকেছে। তার এসব অপকর্মের ঘটনা নেত্রীর কানে পৌঁছানোয় তাকে বাদ দিয়ে আমাকে নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জাফর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে মারধর করছেন। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা না হলে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হতে পারে।
তবে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে এমপি জাফর বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র করছে। মনগড়া তথ্য দিয়ে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দিয়েছে তারা। দুদক অভিযোগের তদন্ত করছে। সত্যতা পেলে আমার বিরুদ্ধে যে প্রতিবেদন দেবেম তা আমি মেনে নেব। দলীয় নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দেননি বলেও দাবি করে বলেন, আমি তাদের অভিভাবক। তবে নাশকতা সৃষ্টিকারী এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ব্যক্তি অপরাধে কারও বিরুদ্ধে মামলা হলে তার দায় আমার নয়।
এদিকে একজন দলীয় প্রার্থীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে তুহিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষোভের কারণে বক্তব্যে বলে ফেলা অকথ্য ভাষাটি আসলে অপ্রত্যাশিত ভাবে হয়েছে। আমি সালাহ উদ্দীনকে উদ্দেশ করে এমন কথা বলিনি। যারা আমার বাবার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের উদ্দেশে বলেছি। রাত-দিন একজন সংসদ সদস্যকে তুই-তোকারি ও গালাগাল করে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশে এসব বলেছি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সালাহ উদ্দীন আহমদ বলেন, আমাকে হুমকি বা গালাগাল করা তুহিনের বাবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তারা যদি দলের গঠনতন্ত্র নিয়মভঙ্গ করে এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করে তাহলে আমি সংগঠনকে জানাব।