কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি থেকেও অনেকে স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এমনকি সেখান থেকেই অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে দুষ্কৃতকারীরা। দেশের বিভিন্ন কারাগারে সম্প্রতি নিরাপত্তাহীনতার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। কারাবন্দিদের ওপর নজরদারির ঘাটতিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নিরাপত্তা জোরদারে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কোনোভাবেই বাইরের লোকজনের সঙ্গে বন্দিদের যোগাযোগ ঠেকানো যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনের অবৈধ ব্যবহার ঠেকাতে ২০১৬ সালে ৮টি কারাগারে মোবাইল জ্যামার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিল কারা অধিদপ্তর। দুই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু ৮ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত জ্যামার কিনতেই পারেনি কারা অধিদপ্তর।
জানা গেছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও কারা বিভাগকে শক্তিশালী করতে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রকল্প নেয় কারা অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মোবাইল জ্যামার স্থাপনসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ জেলার আটটি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ২৪টি জেলা কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা করা হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের এই প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু আট বছর পার হলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে একবার সংশোধন হয়েছে আর বারবার বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। সম্প্রতি ষষ্ঠবারের মতো প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
দুই বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় প্রথমে এক বছর সময় বাড়ানো হয়েছিল। সেবার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও শেষ না হওয়ায় ১৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় এবং মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। সেই সময় ব্যয় ৪৯ কোটি ৯০ লাখ নির্ধারণ করে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ছয়বার বাড়ানো হলো।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় মোবাইল জ্যামার ছাড়া অন্য সব পণ্য কেনা হয়েছে। মূলত এই যন্ত্রটি কিনতে না পারার কারণেই বারবার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রকল্প সংশোধন প্রস্তাব করা হচ্ছে। আর কারা নিরাপত্তার জন্য মোবাইল জ্যামার জরুরি মনে করে তা অনুমোদন করছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে বিভিন্ন যৌক্তিকতা উপস্থাপন করে বাস্তবায়নের মেয়াদ ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পর্যালোচনা সভা এবং বাস্তবতার নিরিখে মেয়াদ ১ বছর বৃদ্ধি করার প্রয়োজন। এজন্য প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্প মূল্যায়নের দায়িত্বে থাকা পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটিতে ধীরগতিসহ বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যা আছে। এ ধরনের একটি ছোট প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা হতাশাজনক। কারাগারে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করার কথা বলে বারবার এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে; কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কারা অধিদপ্তরের আন্তরিকতা দেখা যায় না।
বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণ হিসেবে সর্বশেষ প্রস্তাবে কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় কমপ্রিহেনসিভ মোবাইল ফোন জ্যামার ছাড়া অন্যান্য সব আইটেম কেনা হয়েছে। কিন্তু জ্যামার কেনার জন্য তিন দফা দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানই একক প্যাকেজের দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এজন্য উন্মুক্ত ক্রয় পদ্ধতির পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সরবরাহের জন্য চলতি বছর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গতানুগতিক সাধারণ পণ্যের বাইরে একটি বিশেষ ধরনের পণ্য হওয়ায় জ্যামার আমদানি করে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এজন্য নতুন করে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে বাস্তবায়নকাল ২০২৩ সালের জুনের পরিবর্তে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় আটটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩০০ বর্গফুট এবং জেলা কারাগারগুলোতে ২২৫ বর্গফুট আয়তনের একতলা ভিতবিশিষ্ট একটি করে সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নির্মাণ। এ ছাড়া ১৩০টি মোবাইল ফোন জ্যামার সলিউশন, ৭৪ সেট নেটওয়ার্ক ভিডিও রেকর্ডার, ১ হাজার ১৪২টি আইপি বুলেট ক্যামেরা, ৪৩টি ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনার পরিকল্পনা করা হয়। এর বাইরে দুই সেট বডি স্কানার, ছয় সেট লাগেজ স্কানার, ৩২ সেট সিকিউরিটি সাইরেন সিস্টেম, ৩৪টি আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর, ৮০টি হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর ও ৩২ সেট টেনয় সিস্টেম সংগ্রহ করার কথা।