মূল্যবান পাঁচটি খনিজ পদার্থ আহরণে দেশে প্রথমবারের মতো নদীর চরাঞ্চল ইজারা দিতে যাচ্ছে সরকার। প্রথম দফায় গাইবান্ধা জেলার সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর তিনটি এলাকায় শুরু হচ্ছে এই প্রক্রিয়া। এজন্য আগামী মাসেই অস্ট্রেলিয়ার এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেডের (ইএমএল) সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করবে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে ইজারা চুক্তিতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নদীর বালুচর ইজারা চুক্তির কার্যপরিধি চূড়ান্ত করতে আগামী ১৯ ডিসেম্বর নেগোসিয়েশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মোহাম্মদ জাকীর হোসেন।
ইজারা-সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) মোহাম্মদ জাকীর হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘নদীর বালু থেকে খনিজসম্পদ আহরণে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। সামনে এ বিষয়ে আমাদের বৈঠক আছে।’
কবে নাগাদ চুক্তি সম্পন্ন হতে পারে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি প্রক্রিয়াধীন।’
বিএমডির পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আবুল বাসার সিদ্দিক আকন বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বালু থেকে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজসম্পদ আহরণ করছে। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানিটি নদীর বালু থেকে ভারী ও মূল্যবান পাঁচটি খনিজ পদার্থ আহরণ করবে। এজন্য চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে।’
ভারী পাঁচটি খনিজ পদার্থ বাদে অন্যান্য খনিজ পদার্থের কী হবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো আলোচনা চলছে।’
জানা গেছে, গাইবান্ধার সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বালুচরের তিনটি এলাকা বা ব্লকে মূল্যবান ও ভারী পাঁচটি খনিজ পদার্থ অনুসন্ধান করবে অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি ইএমএল। এ তিনটি ব্লকের মোট আয়তন ২ হাজার ৩৯৫ হেক্টর। এর মধ্যে প্রথম ব্লকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় যমুনাপাড়ে অবস্থিত বালাসির ৭৯৯ হেক্টর এলাকা রয়েছে। দ্বিতীয় ব্লকের মধ্যে রয়েছে মোল্লারচরের ৭৯৮ হেক্টর এলাকা এবং তৃতীয় ব্লকের মধ্যে রয়েছে কামারজানির ৭৯৮ হেক্টর এলাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চূড়ান্ত ইজারা চুক্তির পর ইজারার আওতাধীন এলাকা থেকে মূল্যবান খনিজ পদার্থ জিকরন, রুটাইল, গারনেট, ম্যাগনেটাইট ও ইলমেনাইট আহরণ করা হবে। এর মধ্যে খনিজ পদার্থ জিকরন সিরামিক, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও মোল্ডিং সেন্ডসে (ছাঁচ নির্মাণে ব্যবহৃত বালু) ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন, ব্রাজিল, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ খনিজ উপাদানটি রপ্তানি করে থাকে।
রং, প্লাস্টিক, ওয়েলডিং রড, কালি, খাবার, কসমেটিকস, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রুটাইল নামক খনিজ পদার্থ। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবান এই খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে।
ভারী ও মূল্যবান খনিজ গারনেট ব্যবহার করা হয় সিরিশ কাগজ উৎপাদন, লোহাজাতীয় পাইপ পরিষ্কার ও বালুতে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সারা বিশ্বে খনিজটি রপ্তানি করে থাকে।
ম্যাগনেটাইট খনিজটি চুম্বক উৎপাদন, ইস্পাত উৎপাদন, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা পরিষ্কার করা ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর কূপ খননে ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বের মাত্র দুটি দেশ মূল্যবান এ খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে থাকে। দেশ দুটি হলো দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া।
এ ছাড়া ইলমেনাইট খনিজটি টিটেনিয়াম মেটাল তৈরি, ওয়েল্ডিং রড তৈরি ও রং উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফিকা, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত মূল্যবান এ খনিজটি সারা বিশ্বে রপ্তানি করে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালে এভারলাস্ট মিনারেলস লিমিটেড (ইএমএল) গাইবান্ধা জেলার সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর বালুচর ও নদীবক্ষের চার হাজার হেক্টর ভূমিতে খনিজ বালু অনুসন্ধানের জন্য বিএমডির কাছে আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএমডির একটি প্রতিনিধিদল উল্লিখিত এলাকা পরিদর্শন করে। পরে তাদের লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশসহ অনুমোদনের জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো হয়। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে অনুমতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি অনুমোদন দেন।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ইএমএলকে প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য অনুসন্ধান লাইসেন্স দেয় বিএমডি। পরে লাইসেন্সের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। কোম্পানিটি তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করে চলতি বছরের মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং সম্ভাব্যতা যাচাই ও উত্তোলন পরিকল্পনা জমা দেয় বিএমডির কাছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বালুতে যেসব খনিজ পদার্থ পাওয়া ও উত্তোলন করা যাবে, সেগুলো বাংলাদেশ এখন আমদানি করে। দেশেই এসব মূল্যবান খনিজ আহরণ করা গেলে আমদানিনির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও সুযোগ রয়েছে।
কোম্পানিটির অনুসন্ধান ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অনুসন্ধান করা এলাকায় জিকরনের সম্ভাব্য মজুত রয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৯১ টন। ১০ বছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৭১ টন উত্তোলন করা যাবে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি টন জিরকনের মূল্য ১ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার।
রুটাইলের সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৮৮ টন। ১০ বছরে উত্তোলন করা যাবে ১ লাখ ৪০ হাজার ৮৮৯ টন। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি টন টাইলের মূল্য ৮৪০ মার্কিন ডলার। গারনেটের সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৪১৭ টন। ১০ বছরে উত্তোলন করা যাবে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৬৭ টন। প্রতি টন গারনেটের মূল্য ৭৫ থেকে ২১০ মার্কিন ডলার।
ম্যাগনেটাইটের সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ৬ লাখ ১১ হাজার ৪২৯ টন। ১০ বছরে উত্তোলন করা যাবে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৮ টন। প্রতি টন ম্যাগনেটাইটের দাম ৮৪ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ইলমেনাইটের সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ৮ লাখ ৬৫ হাজার ১১৯ টন। এর মধ্যে ১০ বছরে উত্তোলন করা যাবে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৪ টন। প্রতি টন ইলমেনাইটের দাম ১১০ মার্কিন ডলার।
ইনফোগ্রাফ
১৫ ডিসেম্বর তারিখের ফটো ফোল্ডারে ‘সেন্ড মিনারেলস’ নামে ছবি আছে