আতাউর রহমান, ঢাকা ও স্বপন চন্দ্র সরকার, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলা কাটে ভাগনে রাজীব

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে মা-বাবা-মেয়ে হত্যা
মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলা কাটে ভাগনে রাজীব

ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিক এসেছিল মামা বিকাশ সরকারের বাসায়। তিনি তখন বাসায় না থাকায় মামি স্বর্ণা রানী সরকার আতিথেয়তায় কার্পণ্য করেননি। ভাগনের জন্য দোকানে গিয়েছিলেন কফি কিনতে। ফিরে এসে দেখেন আদরের একমাত্র সন্তান ১৬ বছর বয়সী পারমিতা সরকার তুষি রক্তাক্ত অবস্থায় খাটের ওপর পড়ে আছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে তিনি চিৎকার দিতেই ভাগনে রাজীব স্বর্ণা রানীর মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে। এর কিছুক্ষণ পরই বাসায় ঢোকেন মামা বিকাশ সরকার। একই কায়দায় তাকেও রড দিয়ে আঘাত করা হয়।

ঘাতক রাজীবের স্বীকারোক্তি—‘তখন পারমিতা আর মামি গোঙাচ্ছিল। মরেনি ভেবে হাঁসুয়া দিয়ে ওদের জবাই করে ফেলি। এরপর মেঝেতে পড়ে থাকা মামার গলাও আলাদা করে দিই।’

গত শনিবার সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার পৌর শহরের গোপালজিউ মন্দিরের পাশে নিজের ফ্ল্যাটে বিকাশ সরকার (৪৫), তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার (৩৫) ও মেয়ে পারমিতা সরকার তুষি নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ঘটনার দুদিন পর মঙ্গলবার পুলিশ তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। বাসার ভেতর এই ট্রিপল মার্ডারের পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। লাশ উদ্ধারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাজীব ভৌমিককে গ্রেপ্তার করে রহস্য উদ্ঘাটন করে। হত্যায় ব্যবহৃত হাঁসুয়া (দা), রড ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ।

ঘাতক রাজীব ভৌমিক নিহত বিকাশ সরকারের আপন ভাগনে। বিকাশ সরকার কৃষিকাজের পাশাপাশি ভাগনের সঙ্গে খাদ্যশস্যের ব্যবসা করতেন।

কেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ডসিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল কালবেলাকে বলেন, রাজীবের বাবা বিশ্বনাথ ভৌমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে মারা যান। এরপর বাবার পেনশনের টাকা পেয়ে পরের বছর খাদ্যশস্য গুদামজাতের ব্যবসা শুরু করে। ২০২২ সালের দিকে মামা বিকাশ সরকারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়ায়।

পুলিশ সুপার বলেন, বিকাশ সরকার ভাগনের কাছ থেকে বারবার টাকা দাবি করছিলেন। তিনি লভ্যাংশসহ ৩৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে চাপ দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে তাকে কয়েক দফায় বকাঝকাও করেন। এতে বিকাশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে রাজীব।

ফোন কলের সূত্র ধরে শনাক্ত ঘাতক

পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান বলেন, চাঞ্চল্যের এ ঘটনায় খুনি শনাক্তে ২০ সদস্যের বিশেষ টিম গঠন করা হয়। একপর্যায়ে প্রযুক্তিগত তদন্তে দেখা যায়, ভাগনে রাজীব গত শনিবার তার মামাকে ফোন দিয়ে পাওনা টাকা দিতে চায়। তখন মামা বিকাশ ওই টাকা ফেরত দিতে বাসায় আসতে বলেন। তবে তিনি অন্য একটি কাজে তখন শহরের বাইরে থাকায় রাজীবকে টাকা নিয়ে তার বাসায় যেতে বলেন। ওই সুযোগে সে মামাকে হত্যার জন্য বাসায় যায়। এর আগে একটি দোকান থেকে একটি রড ও হাঁসুয়া কিনে তা ব্যাগের ভেতর নেয়। ওই ফোনের সূত্র ধরেই গ্রেপ্তার হয় রাজীব।

খুনির মুখে ভয়ংকর বিবরণ

গ্রেপ্তারের পর রাজীব সব অকপটে স্বীকার করে তিনজনকে হত্যার ভয়ংকর বিবরণ দিয়েছে। জানিয়েছে, সে সেদিন সন্ধ্যার আগে মামার বাসায় যায়। মামা তাকে ফোনে অপেক্ষা করতে বলেন। মামি তখন সান্ধ্য পূজা করছিলেন। তা সেরে দোকানে যান তার জন্য নাশতা কিনতে। তখন মামাতো বোন পারমিতা তার সঙ্গে রাগারাগি শুরু করে। কেন তার বাবার টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, তা জানতে চায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে খাটে শুয়ে থাকা পারমিতাকে মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে সে। এতে পারমিতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মামি কফি নিয়ে বাসায় ফেরেন। তখন তিনি পারমিতার রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। এতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মামিকেও রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে।

রাজীব জানায়, মা-মেয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। তাদের মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তখন সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। একপর্যায়ে বিছানার চাদর দিয়ে মেঝের রক্ত ঢেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তখন বাসার বাইরে থেকে কলিং বেল বেজে ওঠে। ভেতর থেকে দেখতে পায় তার মামা এসেছেন। এতে ঘাবড়ে যায় সে। এরপর দরজা খুলে দিতেই রক্ত দেখে মামা চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখনই তাকে রড দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়।

রাজীব বলে, ‘ওই সময়ে মামি ও পারমিত গোঙাচ্ছিল। মামাও কাতরাচ্ছিলেন। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তিনজনকেই হাঁসুয়া দিয়ে জবাই করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে পালিয়ে যাই।’

পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল জানান, রাজীবের দেওয়া তথ্যমতে, তাড়াশে উৎপল কর্মকারের পুকুর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রড উদ্ধার করা হয়েছে। রাজীব হাঁসুয়াটি তার বাড়িতে নিয়ে রেখেছিল। সেটি সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া সে সেদিন যে মোটরসাইকেলে এসেছিল, সেটিও জব্দ করা হয়েছে।

বিকাশ ও স্বর্ণার স্বজনরা জানিয়েছেন, ১৫ বছর ধরে বিকাশ-স্বর্ণা দম্পতির কোনো সন্তান না হওয়ায় তারা আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে ছিলেন। তবে সাত মাস আগে স্বর্ণা সন্তানসম্ভবা হন। এতে পরিবারটিতে আনন্দ চলছিল। সেই পরিবারটিকেই শেষ করে দিল আপন ভাগনে রাজীব। অথচ এই রাজীবকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ছিলেন মামা বিকাশ।

এদিকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে একই পরিবারের তিনজনের হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা। গতকাল বুধবার মিলন কান্তি দত্ত, মনীন্দ্র কুমার নাথ, বিপ্লব দে ও সাগর হালদারের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এই দাবি জানান।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু ভিসায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ

দেশে আজ থেকে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে

জি৭ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যুগান্তকারী চুক্তি

জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলেন আ.লীগ নেতা

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

মালয়েশিয়ায় ৫ গাড়ির ভয়াবহ সংঘর্ষ

মুরাদনগরে নারীকে নির্যাতনের ঘটনায় আসিফ মাহমুদের স্ট্যাটাস 

নারীকে ন্যাড়া ও বিবস্ত্র করে খাটের সঙ্গে বেঁধে মারধর

কুমিল্লায় ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি ফজর আলী গ্রেপ্তার

আজ পরীক্ষায় বসবেন সেই আনিসা

১০

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে ঝড় 

১১

কুমিল্লায় নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, ভিডিও ভাইরাল করা তিনজন গ্রেপ্তার

১২

২৯ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

২৯ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

অপারেশন সিঁদুরে নেতৃত্ব দেওয়া সেই পরাগ হলেন ‘র’ প্রধান

১৬

ছায়া সংসদে বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন ইডেন মহিলা কলেজ

১৭

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় থানা ঘেরাওয়ের অভিযোগ

১৮

নানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙলা কলেজের আবুল কাসেম ছাত্রাবাস

১৯

পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই : মেঘনা গুহঠাকুরতা

২০
X