দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত। কয়েকদিন বাদেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এর পরই আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই তিন দিবসেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ব্যবহৃত হয় ফুল। ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারা-হাড়িয়া অঞ্চলের ফুলচাষিরা বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিজেদের ক্ষেতের ফুলগাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
মূলত এই তিন দিবস ঘিরে জমে ওঠে গদখালীর ফুলবাজার। অন্য সময়ের চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে বেশি দামে ফুল বিক্রি হওয়ায় গাছের বাড়তি যত্নও নেন কৃষকরা। সময় যত ঘনিয়ে আসছে পাইকারি বাজারে ফুলের দামও তত বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ফুলের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। ফুল চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সামনের এই তিন দিবসে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।
গতকাল শুক্রবার সকালে কাকডাকা ভোরে চাষিরা বিভিন্ন যানবাহনে করে তাদের চাষের ফুল নিয়ে এসেছিলেন ফুলের পাইকারি বাজার গদখালী বাজারে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরব ফুলবাজারটি। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই ধারে বিভিন্ন জাতের ফুলের পসরা সাজিয়েছেন কৃষকরা। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল, কেউ মোটরসাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দামাদামিতে ব্যস্ত।
বাজারে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ১৪ থেকে ২০ টাকা দরে,
যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হতো ১০ থেকে ১২ টাকায়। প্রতি পিস রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকায়, যা আগে ছিল ৮-১০ টাকা। রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৬ টাকা, যা আগে ছিল ৮-১০ টাকা। জারবেরা বিক্রি হয়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা। তবে কৃষকরা বলছেন, এ বছর জারবেরার উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি আঁটি ২০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়, যা আগে ছিল ২০-২৫ টাকায়। মালা গাঁথার জন্য চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি হয়েছে ১০০ ফুল ২০০ টাকায়। গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে প্রতি হাজার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়, যা আগে ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। লিলিয়াম প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা। দুই দিন আগেও যেটা ছিল ১০০ টাকা।
হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের ফারুক হোসেন ৩০০ গোলাপ বিক্রির জন্য এনেছিলেন। তিনি বলেন, প্রতি ১০০ ফুল বিক্রি করেছি ১ হাজার ৯৫০ টাকায়। ২ বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি, এ বছর পচন রোগের কারণে উৎপাদন কম। তবে দাম বেশি হওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
টাওরা গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম ৯ কাঠা জমিতে গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ৮-১০ টাকা গোলাপের দাম ছিল। আজ (গতকাল) ২০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে।
পানিসারা গ্রামের সোহান আড়াই বিঘা জমিতে জারবেরা চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এ বছর ফুলের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। ইজতেমার কারণে শুক্রবার একটু দাম কম। জারবেরা ৮-১০ টাকায় বিক্রি করছি। আগামী দু-তিন দিনে দাম আরও বাড়বে।
ফুল ব্যবসায়ী রনি আহমেদ বলেন, বাজারে গোলাপের খুবই সংকট। ভালোবাসা দিবসের আগের বাজারে ২৫ টাকাও ফুল পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
আরেক ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘গাঁদা ফুলের দাম একটু কম ছিল, তবে আজ (শুক্রবার) থেকে দাম উঠতে শুরু করেছে। প্রতি হাজার গাঁদা বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা।’
টাওরা গ্রামের আক্তারুল ইসলাম বলেন, এ বছর পচন রোগের কারণে গোলাপের উৎপাদন কম হয়েছে, এজন্য দাম বেশি।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এই অঞ্চলে অন্তত ৬৫০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়। ফুল উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ফুল-সংশ্লিষ্ট কাজে লক্ষাধিক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।
সরেজমিন দেখা যায়, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, নাভারন ও পানিসারা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে নানা জাতের ফুল। এই অঞ্চলের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিউলাস, রজনীগন্ধা, গাঁদা, লিলিয়াম, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ অন্তত ১১ ধরনের ফুল।
১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন বসন্ত উৎসব ও ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাজার সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন ফুলচাষিরা। উৎসব পর্যন্ত গাছে ফুল ধরে রাখতে, পোকার আক্রমণ ও পচন রোধে তারা বাড়তি পরিচর্যা করছেন।
টাওরা গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, ভালোবাসা দিবসে রজনীগন্ধা ও ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে গাঁদা ফুল বিক্রি করব। এজন্য এখন ফুলের পরিচর্যা করছি। বিশেষ করে, ফুলের মান ভালো রাখতে এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে ভিটামিন ও কীটনাশক ব্যবহার করছি। আশা করছি, ভালো দামে ফুল বিক্রি করতে পারব।
হাড়িয়া নিমতলা গ্রামের নয়ন হোসেন বলেন, ১৮ কাঠা জমিতে গোলাপের চাষ করছি। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বিক্রির জন্য ফুলে ক্যাপ পরিয়ে রাখা হয়েছে। এখন নানা ধরনের ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে, যাতে ফুল নষ্ট না হয়।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, সারা বছর ফুল বিক্রি হলেও মূলত বসন্ত বরণ, ভালোবাসা দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘিরে বেচাকেনা বেশি হয়। আসন্ন তিন দিবসকে ঘিরে অন্তত শতকোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা আশা করছি।