শিতাংশু ভৌমিক অংকুর
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০২:২২ এএম
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০৭:১৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বেইলি রোড

নাটকপাড়া থেকে ভোজনবিলাসী

নাটকপাড়া থেকে ভোজনবিলাসী

মহিলা সমিতি আর গাইড হাউস—রাজধানীর বেইলি রোডের এই দুই মঞ্চকে ঘিরেই একসময় আবর্তিত হতো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। ছুটির দিন তো বটেই, শান্তিনগর চৌরাস্তা থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মোড় পর্যন্ত সপ্তাহজুড়েই জমতো নাট্যপ্রেমীর ভিড়। মঞ্চনাটকে গুরুত্ব বিবেচনায় সিটি করপোরেশন বেইলি রোডের নামকরণ করে ‘নাটক সরণি’।

কাগজে-কলমে রাস্তার নাম রয়ে গেলেও নাটক সরণিতে এখন আর মঞ্চকেন্দ্রিক কোনো ব্যস্ততা নেই। মহিলা সমিতি আর গাইড হাউস মঞ্চে নাটকের শো হয় কালেভদ্রে। সাগর পাবলিশার্স ঘিরে টিকিট সংগ্রহের সেই প্রতিযোগিতাও নেই। দুই দশক ধরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বেইলি রোড হয়ে উঠেছে রাজধানীর ভোজনরসিকদের অন্যতম আকর্ষণ। রাস্তার এ মাথা ও মাথাজুড়ে প্রতিটি ভবনে গড়ে ওঠা অসংখ্য রেস্টুরেন্টে আছে বিচিত্র খাবারের সমাহার। গত বৃহস্পতিবার এমনই একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বেইলি রোড।

বইপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বেইলি রোডের নামকরণ নিয়ে আছে বিতর্ক। সপ্তদশ শতকে মহিশুরের টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নেল উইলিয়াম বেইলির নামে এই রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল বলে অনেকের মত। আবার ওয়াহাবি আন্দোলন দমনে ভূমিকা রাখায় ব্রিটিশরা স্পেশাল বেঙ্গল পুলিশের ডিআইজি এইচ বেইলির নামে ‘বেইলি রোড’ নাম দিয়েছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তবে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মত হলো, বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৮৭৯-১৮৮২) স্যার স্টুয়ার্ট বেইলির নামানুসারে এই রাস্তার নাম রাখা হয় বেইলি রোড।

নামকরণের নেপথ্যে যা-ই থাকুক, বেইলি রোডের নাম ছড়িয়েছিল মূলত এখানকার দুটি মঞ্চ। বেইলি রোড আর বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাস—একে অপরের পরিপূরক। এ দেশে মঞ্চনাটকের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে স্বাধীনতার পর। এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাটক মঞ্চায়ন হলেও বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটিই হচ্ছে দর্শনীর বিনিময়ে এদেশে প্রথম মঞ্চনাটক। আর এ নাটকটির মধ্য দিয়েই বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনের নাটকের সঙ্গে পথচলা শুরু। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের ‘গাইড হাউস’ মিলনায়তন।

শুধু নাটক নয়, বইপ্রেমীদের কাছে বেইলি রোড পরিচিত ছিল ‘বইপাড়া’ হিসেবে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণায় এই সরণি হয়ে উঠত সরগরম।

কালের বিবর্তনে বেইলি রোড এখন গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির পরই ঢাকার অভিজাত এলাকার তালিকায়। বেইলি রোডের আভিজাত্য আগের মতোই অটুট থাকলেও অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণে স্বকীয়তা হারিয়েছে বেইলি রোড। হারিয়ে গেছে ‘নাটকপাড়া’ খ্যাতি।

বেইলি রোডের এই বিবর্তন সম্পর্কে নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মহিলা সমিতির হলটি ছিল এক সময়ের মঞ্চ নাটকের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটিকে ঘিরেই চলত মঞ্চের মানুষদের কাজ, আড্ডা। সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ছিল মঞ্চনাটকের রমরমা অবস্থা। ঢাকার অধিকাংশ মঞ্চনাটক এই মহিলা সমিতির হলেই মঞ্চায়িত হয়েছে। নাট্যকর্মী, কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিমনা মানুষের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছিল এই নাটক সরণি।’

তিনি বলেন, ‘তখন এ এলাকায় কয়েকটি তাঁতের শাড়ির দোকান গড়ে উঠেছিল। একটা সময় মহিলা সমিতি হলটি সংস্কারের জন্য বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। তখন আমরা নাট্যকর্মীরা যে যেভাবে পেরেছি হলরুমটি যেন দ্রুত সংস্কার হয় তার জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। তবে যতদিনে এই সংস্কার কাজ চলেছে, ততদিনে মঞ্চনাটক শুধু মহিলা সমিতির হল বা নাটক সরণিতে (বেইলি রোড) সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিল্পকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নাটকগুলো মঞ্চায়িত হতে শুরু করে। তবে আমরা যখন আবার মহিলা সমিতির হল বা নাটক সরণিতে ফিরলাম তখন দেখলাম ওই স্থানে হোটেল-রেস্টুরেন্টের আধিপত্য। এখন মঞ্চনাটক শুধু মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক নেই। এখন অধিকাংশ মঞ্চনাটক শিল্পকলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মিরপুর ও পুরান ঢাকায় হচ্ছে নিয়মিত। নাটক সরণি ছেড়ে নাট্যকর্মী ও সাংস্কৃতিকমনা মানুষের আড্ডাস্থল বিকেন্দ্রীকরণ হতে থাকে। আমরা যদি আবার নাটক সরণিকে শুদ্ধ নাট্যচর্চার মানুষের জন্য নাট্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তবেই নাটক সরণি আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’

আশির দশকে শুরু হয়ে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বেইলি রোডে অন্তত ২০-২২টি তাঁতের শাড়ির দোকান গড়ে উঠেছিল। তবে সেই ধারা স্থায়ী হয়নি। এখন মাত্র কয়েকটি শাড়ির দোকান টিকে আছে। কারণ বহুতল ভবন হচ্ছে একের পর এক। নতুন এসব স্থাপনা চলে যাচ্ছে শাড়ির উদ্যোক্তাদের নাগালের বাইরে। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে জায়গা ভাড়া নিয়ে তাদের পক্ষে আর শাড়ির দোকান করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং নগরবাসীর মধ্যে রসনাবিলাস বেড়েছে। তাই নতুন কোনো ভবন উঠতে শুরু করলে রেস্তোরাঁওয়ালারাই সবার আগে এসে জায়গা ভাড়া নিয়ে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের পাশের জায়গায় থাকা দোকানগুলো উঠিয়ে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। ক্রমে শাড়ি আর নাটকের পরিবর্তে খাবারের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে বেইলি রোড। তখন এই রাস্তায় হাতেগোনা কয়েকটি খাবারের দোকান ছিল । এর মধ্যে এখনো ভালোভাবে টিকে আছে সিরাজ উদ্দিনের ক্যাপিটাল কনফেকশনারি। রোজা এলেই একসময় খোলা জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে মুখরোচক সব ইফতার সামগ্রী বিক্রি করত এই প্রতিষ্ঠান। সে জায়গাটিও এখন সাততলা ভবনের মার্কেটে রূপ নিয়েছে। তার পাশেই আছে পুরোনো সেই কনফেকশনারি। সিরাজ উদ্দিন মারা গেছেন বহু বছর আগে। তার সন্তানরা টিকিয়ে রেখেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সিরাজ উদ্দিনের তৃতীয় ছেলে বশির উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের এই ব্যবসা ব্রিটিশ আমল থেকে। তখন এই এলাকায় তেমন দোকানপাট ছিল না। এটা মূলত একটি অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। আশির দশকে শান্তিনগর মোড় থেকে আমাদের এই প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত অংশটুকু ছিল বাণিজ্যিক। পরে এর আওতা বেড়েছে এবং আবাসিক এলাকায়ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকায় নাট্যজন ও সংস্কৃতিমনা মানুষের আনাগোনা ছিল। তা ছাড়া ঢাকার মূল কেন্দ্রে হওয়ায় এবং আশপাশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে সব রকম মানুষই এখানে ভিড় করে। এসব কারণেই বেইলি রোডে খাবারকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে।’

বেইলি রোডের এই পরিবর্তন সম্পর্কে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বেইলি রোড মূলত একটি আবাসিক এলাকা। তবে মূল রাস্তাঘেঁষা প্লটগুলো বাণিজ্যিক। আর বাকি সব প্লট আবাসিক। সেখানে রাজউক অনুমোদিত কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নেই।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আ.লীগ আমলের লুটপাটের খেসারত দিচ্ছেন ৫ ব্যাংকের গ্রাহকরা

খালি পেটে দুধ চা খাচ্ছেন? জেনে নিন পুষ্টিবিদের সতর্কবার্তা

ইরানের হামলায় ১২ দিনে ধ্বংস হলো ইসরায়েলের ২১টি স্থাপনা

ভারতে বসে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেন আ.লীগ নেতা হানিফ

দিল্লিতে হাসিনার বাড়ির পাশেই সিআরআইয়ের কার্যালয়, মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে কী সমস্যা হয়? যা বলছেন চিকিৎসক

চার মাসের মধ্যে স্বর্ণের দামে রেকর্ড, পিছিয়ে নেই রুপাও

বিএনপিকে শুভেচ্ছা জানালেন সারজিস

দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির আগে ‘মধুর’ সমস্যা বাংলাদেশ দলে

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের মাজারে বিএনপির শ্রদ্ধা

১০

বিএনপিকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা হয়েছে: মির্জা ফখরুল 

১১

টিকটকে এবার যেসব সুবিধা যোগ হলো

১২

মোবাইলে যেভাবে দেখবেন বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ

১৩

হত্যা মামলায় সাবেক সিনিয়র সচিব জিয়াউল গ্রেপ্তার 

১৪

শুটিং শেষ করে শাহিদ কাপুরের আবেগঘন স্ট্যাটাস

১৫

৬০০ বিঘার এই বিলে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সাদা শাপলা 

১৬

ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয়ে আফগানিস্তান, নিহত বেড়ে ৫০০

১৭

নুরের নিরাপত্তা বিবেচনায় বিদেশে চিকিৎসার দাবি জানালেন রাশেদ 

১৮

কে এই লিভারপুলের ২০০০ কোটি টাকার স্ট্রাইকার?

১৯

অনার্স চতুর্থ বর্ষের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন

২০
X