একসময়ের ঢাকার জীবনখ্যাত বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে এখন প্রায় মৃত। নদী রক্ষার নানা আয়োজনের ঢাকঢোল পেটানোর মধ্যেও বুড়িগঙ্গা আবার বর্জ্যের ভাগাড় ও দূষণরাজ্যে পরিণত হয়েছে। নদীর দুই পাড় ঘেঁষে এখন শুধু আবর্জনার স্তূপ। কালো কুচকুচে পানি যেন বিষ। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য সবকিছুর শেষ ঠিকানা নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বুড়িগঙ্গা। এভাবে নদীপাড়ে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় চারদিকের পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সদিচ্ছা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের অনীহার কারণে কিছুতেই প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না বুড়িগঙ্গা। সেইসঙ্গে দুই পাড়ের মানুষ রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
পোস্তগোলা সেতু থেকে বাবুবাজার সেতু পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড় সরেজমিন দেখা গেছে, যে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে একসময় গড়ে উঠেছিল ঢাকা, সেই ঢাকার বর্জ্য এখন ঘিরে ফেলেছে নদীকে। পানি কালো কুচকুচে। পানি থেকে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ। পানির দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর। পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা। ঢাকা মহানগর, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যর একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যের প্রতিটি ফোঁটা এ নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখতে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প, ডাইং কারখানা, সিটি করপোরেশনের ময়লা, সদরঘাট বন্দর—এ চারটি উৎসই বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণ।
নতুন কোনো সমীক্ষা বা গবেষণা না থাকলেও দুই বছর আগে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে পানির পিএইচ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬, ৬ দশমিক ৭ ও ৮ দশমিক ৫। এ ক্ষেত্রে ৭-কে মানদণ্ড ধরা হয়। সমীক্ষায় জানা গেছে, পানিতে মোট ভাসমান অদ্রাব্য পদার্থের (সাসপেন্ডেড সলিড) পরিমাণ ছিল সাধারণ মানদণ্ড ১০-এর বিপরীতে প্রতি লিটারে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫।
প্রতি লিটারে রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) ছিল ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬ মিলিগ্রাম, যার মানদণ্ড ৪। সাধারণ মানদণ্ড শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রামের বিপরীতে জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা (বিওডি) ছিল প্রতি লিটারে ৮৭, ৭২ ও ১০৬ মিলিগ্রাম, যা পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ বলে মনে করছেন অনেক পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. জামিল ফয়সাল বলেন, বুড়িগঙ্গার দূষণের ভয়াবহতা আমরা সবাই জানি। দূষণের ফলে দুই পাড়ের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চর্ম রোগসহ বায়ু ও পানিবাহিত রোগের মাত্রা বেড়েছে। ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে এখনই নদীদূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সরকারের। বিশেষ করে কারখানাগুলোর বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধিত করে যেন নদীতে ফেলা হয়। সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারে বিভিন্ন সংস্থাকে আরও বেশি কড়াকড়ি হতে হবে। তাহলে নদীও দূষণ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যাবে।
পোস্তগোলা সেতু থেকে পাগলার মেরি অ্যান্ডারসন পয়েন্ট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা তীরের পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে কয়েক ডজন ডাইং কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে একশর বেশি ট্যানারি স্থানান্তরের পর এ কারখানাগুলোকেই এখন বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত রাখার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। হাইকোর্টের একটি আদেশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) ২০২১ সালের শুরুর দিকে শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার অন্তত ৫০টি কারখানার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যাতে তারা বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করতে বাধ্য হয়। তবে হাইকোর্ট ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে কারখানাগুলো ইটিপি স্থাপনের পর পরিষেবার সংযোগ পুনঃস্থাপন করার জন্য ডিওইকে নির্দেশ দেন।
বুড়িগঙ্গায় দূষণ ছড়িয়ে যাওয়া কেরানীগঞ্জের ওয়াশিং প্লান্টগুলো হচ্ছে—আহামদ হোসেন ওয়াশিং, আমেনা ওয়াশিং, সানমুন ওয়াশিং, ইডেন ওয়াশিং, বিসমিল্লাহ ওয়াশিং, লোটাস ওয়াশিং, গ্লোবাল ওয়াশিং, রুবেল ওয়াশিং, আনুস্কা ওয়াশিং, সততা ওয়াশিং, চঞ্জল ওয়াশিং, আব্দুর রব ওয়াশিং, ঢাকা ওয়াশিং, আজান ওয়াশিং, নিউ সাহারা ওয়াশিং, দোহার ওয়াশিং, রিলেটিভ ওয়াশিং, নিউনাশা ওয়াশিং, ইউনিক ওয়াশিং, মৌ ওয়াশিং, সেতু ওয়াশিং, কোয়ালিটি ওয়াশিং, জুয়েনা ওয়াশিং, কামাল ওয়াশিং, ওয়াটার কালার ওয়াশিং, পারজোয়ার ওয়াশিং, জিএম ওয়াশিং, কুমিল্লা ওয়াশিং, আছিয়া ওয়াশিং ও লিলি ওয়াশিং।
হাইকোর্টের নির্দেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের টাস্কফোর্স গত বছরের মে মাসে বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করতে ঢাকা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহিদা বেগম এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নওশীন হকের নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জে খোলামুড়া, বরিশুর, মান্দাইল, জিনজিরা, আগানগর, ইস্পাহানি, কালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, পটকাজোর, মাদারীপুর ও মীরেরবাগ এলাকায় অভিযান চলায়। অভিযানে শাহেদ, রুমা ডায়িং, ওয়াশিংসহ ৮১টি অবৈধ কারখানার গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতে মালিকরা আবারও কারখানা চালু করেন।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে নিয়মিত। আমরা নানা সময় বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। আসলে তারা কেউই কার্যকারী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে কারও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।