স্বপন চন্দ্র দাস, সিরাজগঞ্জ
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০৩:১১ এএম
আপডেট : ২৫ মে ২০২৪, ০৭:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অপরিকল্পিত উন্নয়নের বলি হচ্ছে চলনবিল

অপরিকল্পিত উন্নয়নের বলি হচ্ছে চলনবিল

ভরা বর্ষায় চলনবিলের বিস্তীর্ণ নদী-খাল কিংবা বিলে পাল তোলা নায়ে গাঁয়ের বধূর বাপের বাড়ি যাওয়ার চিত্র এখন বিরল। স্বচ্ছ জলরাশির স্রোতে রুপালি ঝলকে খসল্লা-কাকিলা আর টেংরা-পুঁটির ছুটে চলার দৃশ্যও আর চোখে পড়ে না। আকাশে দেখা যায় না সাদা পালক-শোভিত উড়ে চলা বকের ঝাঁক। পানিশূন্য; তাই দেখা মেলে না পানকৌড়ি আর মাছরাঙারও। বসন্তেও শোনা যায় না কোকিলের গান। দোয়েল, কোয়েল, চড়াই শালিকের দেখা মেলাও ভার। সংকুচিতে হয়েছে চলনবিলের বিস্তীর্ণ মাঠে সবুজ সমুদ্রের ঢেউ। এমনই করুণ অবস্থায় অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে উত্তরবঙ্গের শস্য ও মৎস্যভান্ডার চলনবিল।

উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ, অবাধ পুকুর খনন, স্থাপনা নির্মাণে করে খাল-বিল-নদীর পানিপ্রবাহের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমেই ধ্বংস করা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলময় ভূভাগ চলনবিলকে। কয়েক দশকে চলনবিলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। পানিশূন্য হয়ে মরে গেছে বেশিরভাগ নদী ও খাল। নানা প্রতিকূলতায় বিলুপ্ত হয়েছে হরেক প্রজাতির দেশীয় মাছ, হরেকরকমের পাখিসহ শত শত জলজ ও উদ্ভিজ্জ প্রাণী।

‘চলনবিলের ইতিকথা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, অতীতের চলনবিল ছিল বিশাল জলধি। বিলটি বৃহত্তর পাবনা, রাজশাহী, নওগাঁ ও বগুড়া জেলার অধিকাংশ স্থানজুড়ে বিস্তৃত ছিল। পদ্মা তীরবর্তী লালপুর থানা ছাড়া তদানীন্তন নাটোর মহুকুমার সমগ্র অংশ চলনবিলময় ছিল। তখন বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রাম, পাবনার বেড়া, শাহজাদপুর (অংশবিশেষ) ও নওগাঁর রানীনগরসহ উল্লিখিত জেলাগুলোর মোট ১৪টি থানা বা উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী আরও ২০টি উপজেলায় চলনবিলের প্রভাব ছিল।

এ বিলে ছিল খরস্রোতাসহ ছোট-বড় ৩২টি নদী, ৯৩টি বিল ও ২৬টি খাল। এসব নদী-খাল ও বিল ঘিরে ছোট ছোট অসংখ্য উপনদী, উপখাল ও ছোট বিলও ছিল। উল্লেখযোগ্য নদীর মধ্যে বড়াল, আত্রাই, গুমানী, ইছামতী, করতোয়া, গোহালা, ভদ্রাবতী, বিলসূর্য, গুড়, কুমারডাঙ্গা, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন-কানেশ্বরী, সরস্বতী, মুক্তাহার, নাগর, বানগঙ্গা, ভাদাই, গদাই, শালিকা, কাটাগাঙ, তুলশীগঙ্গা, বারণী, ফুলজোড়, ইত্যাদি। ২৬টি খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নিমাইচড়া খাল, দোবিলা খাল, গোহালার খাল, কিশোরখালী খাল, বেহুলার খাড়ি, বাকাই খাড়ি, পানাউল্লার খাল, উলিপুর খাল, গুমানী খাল, কুমারভাঙ্গা খাল, গাড়াবাড়ী খাল ও কাটাবাড়ী খাল ইত্যাদি। খালগুলো ১২ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ। ৯৩টি বিলের মধ্যে সিংড়ায় পাঁচ, গুরুদাসপুর তিন, চাটমোহরে ২০, ভাঙ্গুরা ১৮, ফরিদপুর দুই, শাহজাদপুর আট, উল্লাপাড়া ২০ ও রায়গঞ্জে ১৭টি। এসব বিল ছাড়াও শতাধিক ছোট উপবিলও ছিল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার চলনবিলের বুক চিরে সিরাজগঞ্জ থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত রেলসড়ক নির্মাণ করার পর থেকেই স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে ভাটা পড়ে। ২০০৩ সালে সিরাজগঞ্জের নলকা-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের পর চলনবিলের পানিপ্রবাহে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এ মহাসড়ককে ঘিরে অসংখ্য রাস্তা নির্মাণ হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে বাধাগ্রস্ত হয় বিলের পানিপ্রবাহ। এ ছাড়া খাল বা নদীর মুখ বন্ধ করে অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। ফলে পানির গতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমে দ্রুত ভরাট হচ্ছে বিলের গভীরতা। আর নাব্য হারিয়ে সংকুচিত হচ্ছে বিলের আয়তন। চলনবিলের অস্তিত্বে সর্বশেষ আঘাত হেনেছে পুকুর খনন। যত্রতত্র পুকুর খনন করে পানিপ্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। মাত্র ১২ বছরের ব্যবধানে বিস্তীর্ণ চলনবিলে অন্তত আট থেকে ১০ হাজার পুকুর খনন করা হয়েছে।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, চলনবিলের প্রধান নদী বড়াল। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে চলনবিলের মাঝখান দিয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। বড়ালের সঙ্গে প্রায় ১০০টি ক্যানেল ও প্রতিটি ক্যানেলের সঙ্গে পাঁচ-সাতটি করে বিল যুক্ত আছে। অসংখ্য বিলের সমন্বয়ে চলনবিল। পদ্মা-যমুনায় যখন অনেক পানি হয়, তখন বড়ালের মাধ্যমে চলনবিলে ছড়িয়ে যায়। এ নদীটির গতিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলনবিলকেই ধ্বংস করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে চারঘাটে ৫শ ফুট চওড়া বড়াল নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিয়ে ৩০ ফুট স্লুইসগেট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২৫ ফুট গভীরতার নদীটিকে নিচ থেকে ঢালাই দিয়ে ৮ ফুট গভীর করা হয়। পাউবোর হিসাবে আগে ২১ হাজার কিউসেক পানি যেত বড়াল দিয়ে। স্লুইসগেট নির্মাণের পর সেখান দিয়ে ৫ হাজার কিউসেক পানি যেতে পারে। একটি খরস্রোতা নদীকে এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, চলনবিল রক্ষায় হাওরের মতো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সব রাস্তা ভেঙে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা প্রয়োজন। চলনবিলের সামগ্রিক ক্ষতির বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নয়ন করতে হবে।

বাপা সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির আহ্বায়ক দীপক কুমার কর কালবেলাকে বলেন, চলনবিলের মধ্যে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক হচ্ছে গোদের ওপর বিষফোড়া। এতে চলনবিল বিলুপ্তির অবস্থা আরও ত্বরান্বিত করেছে। সেটি উড়াল সড়ক হলে ভালো হতো। শুধু চলনবিলই নয়, কোনো সুবৃহৎ জলাশয়ের ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করতে হলে সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে উড়াল সড়কই করা উচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানী মো. সুলতান-উল-ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বঙ্গীয় বদ্বীপে স্বাভাবিকভাবেই প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার মধ্যে চলনবিল অন্যতম। চলনবিল প্রকৃতিগতভাবে যতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। এখানে আশির দশকে সেচের উন্নয়নের নামে বিলাঞ্চলে ও নদীগুলোতে জলকপাট লাগিয়ে যেটা করা হয়েছে, তাতে চলনবিলের চলম বিপর্যয় ঘটেছে। উন্নয়নের নামে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে অপরিকল্পিত বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় চলনবিলের প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ও পরিবেশ চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। নাটোর ও চাটমোহরের কোনো কোনো স্থানে বড়াল নদীতে বাঁধ দিয়ে পুকুরে পরিণত করা হয়েছে। শুধু বড়াল নয়, করোতায়া, নন্দকুজা, নারদ, তুলশীগঙ্গা ও আত্রাই নদীপ্রবাহে কৃত্রিমভাবে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব কারণে চলনবিল আর বিল নেই, এখন ফসলের মাঠে পরিণত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, চলনবিল রক্ষা করতে হলে পানিপ্রবাহের নদীগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে বয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। জলাশয়ে পরিণত করতে চাইলে সব নদী-খাল পুনর্খনন করা দরকার। পানিপ্রবাহে বাধা দিয়ে রাস্তাঘাট তৈরি করা যাবে না। কোনোভাবেই যত্রতত্র পুকুর খনন করতে দেওয়া যাবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশকে আর তাঁবেদার রাষ্ট্র বানাতে দেব না : চরমোনাই পীর

ভারতের মাটিতে আ.লীগের তৎপরতা নিয়ে ২ দেশের পাল্টাপাল্টি অবস্থান 

শিক্ষককে ছাত্রীর ছুরিকাঘাত, থানায় মামলা

৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীর বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি

হোটেলকক্ষে গোপন ক্যামেরা? মোবাইল দিয়ে শনাক্ত করবেন যেভাবে

পদাবনতি দিয়ে বদলি হলেন সেই কৃষি কর্মকর্তা

আমির খানের গোপন সন্তান থাকার অভিযোগ ভাই ফয়সালের

জিপিএ-৫ পেয়েও কলেজ পায়নি ৫৭৬৫ জন

শিল্পাকে বিয়ে করতে কঠিন শর্ত মানেন রাজ

ভুটানকে হারিয়ে সাফে শুভ সূচনা বাংলাদেশের

১০

৩১ দফার সমর্থনে বিএনপি নেতা ফয়সাল আলীমের গণসংযোগ ও পথসভা

১১

ভারতে আ.লীগের রাজনৈতিক অফিস চালু নিয়ে কড়া অবস্থানে সরকার

১২

সাতক্ষীরায় জেল পলাতক ১১ মামলার আসামি গ্রেপ্তার

১৩

প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শিক্ষিকাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা স্কুলছাত্রের

১৪

শিল্টনের বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ইতিহাস গড়লেন ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার

১৫

ফিল্ম স্টাইলে ব্যবসায়ীর বসতঘরে গুলি

১৬

জানা গেল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে চুলের মুঠি ধরে চড় মারার কারণ

১৭

ঘরের ভেতর জামাকাপড় শুকাচ্ছেন? হতে পারে যেসব বিপদ

১৮

ডিএমপির সাবেক এডিসি নাজমুল বরখাস্ত

১৯

বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নতুন প্ল্যাটফর্ম উদ্বোধন

২০
X