শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৩, ০২:০৫ এএম
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৩, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দালাল ছাড়া মেলে না জন্মনিবন্ধন সনদ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। ছেলের জন্মসনদ করাতে প্রথমে গিয়েছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৯ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখানে একটি দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করলে পরের সপ্তাহে আবার সেখানে যেতে বলা হয় সিদ্দিকুরকে। পরে ওই দোকানে গেলেও সার্ভার নেই বা তথ্য ইনপুট দেওয়া যাবে না বলে জানানো হয়। এভাবে কয়েক সপ্তাহ ঘুরে সনদ না পেলেও দালালের সন্ধান পান তিনি। মাত্র ২ হাজার টাকার বিনিময়ে তাৎক্ষণিক কাজ করার আশ্বাস দিলেও ছেলের জন্মসনদ হাতে পেতে লেগে যায় কয়েক মাস। ঢাকার দুই সিটির বাসিন্দাদের জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে এমন ভোগান্তির গল্প নতুন নয়। প্রায়ই অকার্যকর থাকে নিবন্ধনের সার্ভার। সনদ হাতে পেতে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন। আবেদন থেকে সনদ হাতে পাওয়া পর্যন্ত কয়েক ধাপের বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়। এর সঙ্গে রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে সনদ পেতে লাগছে ৩ থেকে ৬ মাস। নিবন্ধন সনদ নিতে গিয়ে যেন এক তিক্ত অভিজ্ঞতা পান নগরবাসী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় জন্মসনদের। বলতে গেলে, জন্মনিবন্ধন বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা সবার ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন। তবে ঢাকার এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে ভোগান্তিতে পড়েননি। এই ভোগান্তিকে পুঁজি করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দালাল চক্র। ‘দ্রুত সময়ে, কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই জন্মসনদ দেওয়া হবে’—এমন প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা; কিন্তু এতেও মেলে না সমাধান। সার্ভার নেই, মা-বাবার নামের বানান ভুল, অনলাইন কপিতে সমস্যাসহ নানা জটিলতার অজুহাতে মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হয় আবেদন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জন্মনিবন্ধন শিশুর মৌলিক অধিকার। যদি মৌলিক অধিকারই হয়, তাহলে এতটা ভোগান্তি কেন? সবখানেই সিন্ডিকেট। পুরো প্রক্রিয়া দালালদের দখলে। অধিকাংশ কর্মী অদক্ষ। ফি ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা হলেও সনদ পেতে ১ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। কম্পিউটার কম্পোজের দোকানগুলোর লোকজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়। অথচ আগে অ্যানালগ পদ্ধতিতে সহজেই সনদ সংগ্রহ করা যেত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলে তার মা-বাবাকে

প্রথমে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে যেতে হয় সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখান থেকে দেওয়া হয় জন্মসনদ; কিন্তু কোনো ভুল সংশোধন করতে হলে সেটি আর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে যেতে হবে সদরঘাটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এ ছাড়া জন্মসনদ নিতে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করে যেতে হয় সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখানে জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য ইনপুট দেন। পরে সেটি ভেরিফায়েড হয়ে আসে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে। কারওয়ান বাজারে ডিএনসিসি অঞ্চল-১০-এর আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে কয়েকবার ঘুরে আসতে হয়েছে তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা এরশাদ আলী মৃধাকে। তিনি বলেন, মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে কয়েকবার আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে তারা ফিরিয়ে দেয়। বলে, আজ লোক নেই, অন্যদিন আসেন। এক দিন তারা বাইরে থেকে অনলাইনে আবেদন করতে বলেন। আবেদন করে ফের গেলে দীর্ঘক্ষণ সিরিয়ালে থাকতে হয়। এরপর তারা যাচাই-বাছাই করে তথ্য ইনপুট দেওয়ার সময় জানান, আমার জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নামের কিছু বৈসাদৃশ্য আছে। এরপর বেশ কয়েকদিন ঘুরে জন্মনিবন্ধন ঠিক করিয়ে নতুনভাবে জমা দিয়েছিলাম। তবুও মেয়ের সনদ হাতে পাচ্ছিলাম না। পরে দালাল ধরে তারও কিছুদিন পর মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ হাতে পাই। দলালের পেছনে টাকা খরচ হয়েছে ঠিকই। সম্প্রতি ডিএনসিসির অঞ্চল-৩-এর কার্যালয়ে কথা হয় নাজনীন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে আমি যে কী পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি অ্যাক্টিভ বলে এত জায়গায় দৌড়াতে পেরেছি, উনাদের প্রশ্ন করতে পেরেছি। কিন্তু যাদের প্রযুক্তি বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই, বিষয়টি বোঝেনই না তাদের কী হবে? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৯-এর আঞ্চলিক কার্যালয়ের জন্মনিবন্ধন সহকারী বলেন, এটি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভারের সমস্যা। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। সার্ভার ডাউন থাকলে আমরা সেবাগ্রহীতাকে বলে দিই এখন সার্ভার নেই, পরে আসুন। এদিকে জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। নতুন উদ্যোগ অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধনের জন্য সাধারণ মানুষকে আর দূর-দূরান্তের আঞ্চলিক কার্যালয়ে যেতে হবে না। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এটি করা যাবে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছেছে ডিএনসিসি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিঠি চালাচালির পর এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি কার্যকর হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হবেন নিবন্ধক এবং কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব হবেন সহকারী নিবন্ধক। এ ছাড়া নাম বা তথ্য সংশোধনের জন্য আগামীতে আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে না গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়েই এ সেবা নেওয়া যাবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নিলেও ব্যতিক্রম দক্ষিণ সিটিতে। সংস্থাটি আগের মতোই তাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধনের সেবা চালু রেখেছে। পাশাপাশি সংশোধনের বিষয়টি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সম্পাদনের প্রক্রিয়াটিও বিদ্যমান। দক্ষিণ সিটির এক জন্মনিবন্ধন সহকারী বলেন, আমরা আগের নিয়মেই জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়ার কাজ করছি। নতুন করে ওয়ার্ড পর্যায়ে সেবাটি নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিশ্বকাপের সময় পরিবর্তনের ইঙ্গিত

মসজিদে গিয়ে বিপাকে সোনাক্ষী 

মারা গেলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী

বিয়ে কবে হতে পারে জানালেন ইশরাকের হবু স্ত্রী

পাকিস্তান-আফগানিস্তান কার সামরিক শক্তি কেমন

চট্টগ্রাম-৭ আসনে জামায়াতের নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা

পাচারকালে ৩৮০ বস্তা সরকারি চাল জব্দ

গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে এমবাপ্পেকে নিয়ে বড় দুঃসংবাদ

রোমের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেন প্রধান উপদেষ্টা

জিসানের মাটিচাপা মরদেহ মিলল প্রতিবেশীর উঠানে

১০

আশা’র আয়োজনে ‘সাহসী কন্যাদের গল্পকথা’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত

১১

বিশ্বকাপের জন্য ২০ সদস্যের দল ঘোষণা বাংলাদেশের

১২

ন্যায় ও আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে হবে : বাবর

১৩

ফিল্মফেয়ারে রেকর্ড গড়ল ‘লাপাতা লেডিস’

১৪

কলকাতায় অমিতাভের জন্মদিনে চল্লিশা পাঠ

১৫

বায়ুদূষণের শীর্ষ পাঁচে ঢাকা

১৬

বিএনপির ৩১ দফা দেশের মানুষকে বাঁচানোর রূপরেখা : রাশেদুল আহসান

১৭

আফগানিস্তানের ১৯ সীমান্তপোস্ট দখল করেছে পাকিস্তান

১৮

দল কমলেও বিপিএলে বাড়ছে ভেন্যু

১৯

লন্ডনে ইলিয়াস কাঞ্চনকে দেখে যা বললেন রোজিনা

২০
X