দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জোন হিসেবে পরিচিত নরসিংদী জেলা। এখানে রয়েছে অসংখ্য কলকারখানা। এসব কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে বিপুলসংখ্যক মানুষ। সেই নরসিংদী এখন এক আতঙ্কিত জনপদের নাম। এখানে প্রতিনিয়ত খুনখারাবি লেগেই থাকে। গত দুই যুগে এই অঞ্চলে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ খুন হয়েছে। গত দুই মাসে খুন হয়েছে ১৫ জন। খুনের তালিকায় রয়েছেন উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাবেক এক ইউপি সদস্য। এ কারণে মানুষ দীর্ঘদিনের আবাসস্থল ছেড়ে হচ্ছেন ঢাকামুখী। অনেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসাও।
জেলার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদীর রাজনীতিতে খুনোখুনির সংস্কৃতি বেশ পুরোনো। অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়েও এখানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর এখানে এমপি, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্যসহ অর্ধশত জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, ছাত্রনেতা, শিক্ষক এবং নারী, শিশুসহ কয়েক হাজার নিরীহ নিরপরাধ মানুষ খুন হয়েছেন। এসব খুনের অধিকাংশেরই কোনো বিচার হয়নি। মেয়র লোকমান হত্যার পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো হত্যা মামলার চার্জশিট জটিলতা কাটেনি। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ খান, চেয়ারম্যান মানিক, সিরাজুল ইসলাম ও রাজ্জাক চেয়ারম্যান এবং ছাত্রনেতা জিএস রনি হত্যাসহ অধিকাংশ মামলা ঝুলে আছে নানা জটিলতায়। এসব হত্যার বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে ভুক্তভোগীদের স্বজনসহ জেলাবাসী।
জেলাবাসীর মতে, এসব খুনের পেছনে রয়েছে রাজনীতি, গোষ্ঠীগত দাঙ্গা, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, মাদক ও বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের সঙ্গে অপরাধীদের সখ্য ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে খুনসহ নানা অপরাধ বাড়ছে শিল্পোন্নত এ জেলায়।
এলাকার বালু ব্যবসা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আশ্রাফুল সরকার। আর অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছেন চেয়ারম্যান মাহবুব হত্যা মামলার প্রধান আসামি মেম্বার আতাউর।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি দুটি টার্গেট কিলিংয়ের পর জেলাজুড়ে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশা করি শিগগির জেলাবাসী স্বস্তি পাবে।
জেলার চাঞ্চ্যলকর হত্যাগুলোর মধ্যে নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রয়াত মেয়র লোকমান হত্যা অন্যতম। ২০১১ সালের ১ নভেম্বর তিনি দলীয় কার্যালয়ে খুন হন। এ ঘটনায় ১৪ জনকে আসামি করে মামলা হয়। প্রধান আসামি করা হয় তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল দীর্ঘ ৮ মাস তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ২৪ জুন সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ এজাহারভুক্ত ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দাখিল করেন। তিনি তিন নম্বর আসামি শহর আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন ওরফে মোবা, দুই নম্বর আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, তার ছোট ভাই শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম সরকারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন। এ ঘটনার এক মাস পর ২০১২ সালের ২৪ জুলাই আদালতে চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মামলার বাদী। পরদিন আদালত নারাজি আবেদন খারিজ করে অভিযোগপত্র বহাল রাখেন। এরপর নারাজি এবং রিভিশনের মধ্যেই কেটে যায় ১৩ বছর।
মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, যতবার চার্জশিট থেকে প্রকৃত আসামিদের বাদ দেবে, তিনি ততবারই নারাজি দেবেন।
নিহতের স্ত্রী সাবেক এমপি তামান্না নুসরাত বুবলি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন আর বিলম্বিত না হয়। এ হত্যার বিচার হলে হয়তো নরসিংদীতে লাশের মিছিল এত দীর্ঘ হতো না।
শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ হত্যা মামলায় ৬ জনের নাম উল্লেখ এবং ১২ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা হয়। তবে কিলার মোবারককে আসামিই করা হয়নি এ মামলায়। ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো খুনিকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। মামলার বাদী ও নিহতের ছেলে আমিনুর রশিদ খান তাপস বলেন, খুনিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনতোষ বলছেন, আদালত থেকে অনুমতি পেলে আসামিদের দেশের বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করে দেশে আনা হবে।
গত ২৮ মে খুন হয় সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুব আলম। এ হত্যাকাণ্ডে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আজহার অমিত প্রান্ত ও সদস্য আতাউর রহমানসহ ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ এখনো কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এ খুনের সঙ্গে জড়িত তিনজনের নাম পেয়েছেন তারা। ২ নম্বর আসামি মাস্টারমাইন্ড রাসেলকে গ্রেপ্তার করলেও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া যায়নি। এসব কারণে বেশ হতাশ মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই হাফিজ উল্লাহ। তিনি বলেন, আমরা এ হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার চাই।
গত ২২ মে দুপুরে জেলার রায়পুরায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান রুবেলকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। এতে ২৬ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০-৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। প্রধান আসামিসহ এ খুনের উল্লেখযোগ্য কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কাজী নাজমুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাদীই চান না হত্যার বিচার হোক। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অপরাধীদের আসামি করার পাশাপাশি তাদের স্বজনসহ রাজনৈতিক নেতাদেরও আসামি করে মামলা হয়। এতে বিচার কার্য বিলম্বিত হয়। বিচার কার্য বিলম্বিত হলে আদালতে সাক্ষী আসতে চান না। পরে বাদী আর সঠিক বিচার পান না। তিনি বলেন, মামলার বিচার কাজ বিলম্ব হলে বাদীর ক্ষোভ কমে যায়। পরে আর মামলা চালতে তেমন আগ্রহ দেখান না। এ ছাড়া ঘন ঘন মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বদলি হলেও মামলা গতিরোধ হয়।
আদালত ও জেলা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা যায়, সিরাজ চেয়ারম্যান হত্যা মামলার বাদী আশরাফুল আদালতেই আসেন না। মানিক চেয়ারম্যান হত্যা মামলা সিআইডিতে আছে। রাজ্জাক চেয়ারম্যান হত্যা মামলার বাদী (তার ছেলে) এ মামলার প্রধান আসামি জেলার বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রকারী সদর উপজেলার আলোকবালি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাইয়ুম সরকারের সঙ্গে নতুন করে সখ্য গড়ে তুলেছেন। সামাজিকমাধ্যমে তাদের দুজনের ছবি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও সাতবারের এমপি রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, আমরা চাই এ জেলা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রমুক্ত হোক। কোনো খুনাখুনি চাই না। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া ও চেয়ারম্যান মাহবুবসহ সব হত্যাকোণ্ডের দ্রুত বিচার চাই।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষমতা বদলের পাশাপাশি এ জেলায় অপরাধীরাও শেল্টার বদলে ফেলে। এর দায় পুলিশ নেবে কেন? পুলিশের একার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির রেজুলেশন ঘেঁটে জানা যায়, শিবপুরের রবিউল আলম ওরফে কিরণ খাঁ এমপি খুন হন ১৯৮৬ সালের ২৮ এপ্রিল। রাস্তায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ৩৭ বছর পর তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানও খুন হন। সেই খুনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ফজলে রাব্বি খান বলেন, বাবার হত্যার বিচার পেতে ১৮ বছর লেগেছে। এক বছর হয়ে গেলেও চাচা হত্যার প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। বিচার পেতে কত বছর লাগবে, তা বুঝতে পারছি না।
নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা আইনশৃঙ্খলা অবনতির কথা স্বীকার করে বলেন, জেলায় অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই পুলিশকে তৎপর ও গোয়েন্দা নজরধারী বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করে সভা-সমাবেশ করতে হবে।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেব হোসেন কালবেলাকে বলেন, এখানকার মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশসহ প্রশাসনকে আরও কঠোরভাবে কাজ করতে হবে। কোনো গাফিলতি হলে আরও বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারে। যেভাবে কাজ করছে প্রশাসন তাতে শিগগির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখছি না।