প্রীতম পল্লব
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিজয়, ঐতিহ্য ও পোশাক

বাংলার আত্মার ত্রিবেণীসঙ্গম

বাংলার আত্মার ত্রিবেণীসঙ্গম

ডিসেম্বর এলেই বাংলার বাতাসে যেন এক অদৃশ্য সুর বাজতে শুরু করে। শীতের সকালের কুয়াশা ভেদ করে ভেসে আসে স্মৃতির করুণ অথচ গৌরবময় প্রতিধ্বনি। এই মাস, বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর, ইতিহাসের পাতায় শুধু একটি তারিখ নয়; এটি এক জাতির পুনর্জন্মের ঘোষণা। দীর্ঘ দুঃসহ পথ পেরিয়ে যে আলো এসেছিল, তা আজও আমাদের হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত হয় বিজয়ের আবেগ হয়ে।

বাংলার মানুষের জীবনে বিজয় একটি অনুভূতির নাম যা সংগ্রামের, সাহসের এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক। বিজয় আমাদের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন অকুতোভয় মানুষ অন্ধকারের ভেতরেও বিশ্বাস রেখেছিল আলোকিত ভবিষ্যতে। সেই বিশ্বাসই একদিন গড়ে তুলেছিল স্বাধীনতার ভিত্তি।

বিজয়ের এই উজ্জ্বল দিনটি শুধু ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের ঐতিহ্যের ভেতর রক্তের মতো দৌড়ায়। বাংলার মাটির গন্ধ, নদীর সুর, গ্রামবাংলার ধানক্ষেত, উৎসবের ঢাক—সবকিছুতেই মিশে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়। আর সেই শিকড়ের সবচেয়ে দৃশ্যমান, সবচেয়ে বহনযোগ্য রূপ হলো পোশাক। পোশাক, যা শুধু দেহ ঢাকে না; এটি মানুষের পরিচয় বহন করে, অতীতের গল্প বলে, ভবিষ্যতের পথচলার সাক্ষী হয়।

এই বাংলায় পোশাক মানেই ঐতিহ্যের বোনা কবিতা। তাঁতের চাকার ঘূর্ণন যেন সময়কে বুনে রাখে সুতোয়; জামদানির নকশা যেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের নীরব স্মৃতি; নকশিকাঁথায় আঁকা থাকে মায়েদের অদৃশ্য আশীর্বাদ। বিজয় দিবস এলেই লাল-সবুজের পোশাকগুলো বিশেষ এক প্রতীক হয়ে ওঠে, যেন প্রতিটি রঙের ভেতরে বিচ্ছুরিত হয় স্বাধীনতার দীপ্তি, ইতিহাসের গভীরতা আর গৌরবের উল্লাস। মানুষের পরিধানে এ সময়ে দেখা যায় এক নতুন আলো। পরিবারের সবাই একত্রে সাজে বিজয়ের রঙে, যেন পোশাকের মাধ্যমেই তারা প্রকাশ করে গর্ব ও কৃতজ্ঞতা। লাল-সবুজের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ব্যাজ, ওড়না সবই হয়ে ওঠে নীরব ভাষা, নীরব অঙ্গীকার। যেন প্রতিটি নকশা বলে—‘এই মাটির জন্য, এই মানুষের জন্য, এই স্বাধীনতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’

আজকের প্রজন্ম সেই পোশাককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তারা ঐতিহ্যকে সম্মান করে, আবার প্রযুক্তি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি করে নতুন শৈলী। তাদের ডিজাইন, তাদের চিন্তা, তাদের সৃজনশীলতা যেন বিজয়ের চেতনাকে নতুন ভাষায় প্রকাশ করে। তারা জানে, পোশাক শুধু শিল্প নয়; এটি বাঙালির গল্প, অর্থনীতি, কারিগরদের শ্রম আর দেশের আন্তর্জাতিক পরিচয়। বিজয় দিবস তাই পোশাককে এক উৎসবের রূপ দেয়, যেখানে গৌরব লুকিয়ে থাকে নকশায়, ঐতিহ্য বয়ে চলে সুতোয় আর স্বাধীনতার আবেগ ফুটে ওঠে প্রতিটি রঙে।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় এখন ফ্যাশন স্টাইলের অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এ ফ্যাশন-স্টাইলে উৎসবী আমেজ থাকলেও তার থেকে বেশি থাকে দেশাত্মবোধ তথা দেশপ্রেম। আর সে কারণেই বিজয়, স্বাধীনতা কিংবা ভাষা দিবসের ফ্যাশনের প্রথম চিত্রকল্প হিসেবে পোশাকে, শোপিসে কিংবা গহনায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের স্থিরচিত্রের চিত্রকর্ম; বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। ’৭১-এর আত্মত্যাগের বাঙালি ধরনটা যেমন হৃদয়ছোঁয়া, মর্মস্পর্শী, আবেগঘন; তেমনি আনন্দময়তার রেশটাও কম নয়। আর এ ফ্যাশন বোধের মর্মকথাটা চিত্রে ও কবিতার পঙক্তির মাধ্যমে পোশাকে উৎকীর্ণ করার সফল প্রয়াসটা প্রতি বছরের এ বিশেষ দিনগুলোতে করে থাকেন প্রতিষ্ঠিত হাউসগুলোর পক্ষে নিজ নিজ ডিজাইনাররা। এবারের বিজয় দিবসও এর ব্যতিক্রম নয়।

এরই মধ্যে দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসগুলো বিভিন্ন প্রজন্মের ফ্যাশন সচেতনদের জন্য আউটলেট সাজিয়েছে পোশাকের মনোহর পসরা। যেহেতু বিজয় দিবস তাই টি-শার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, শাড়িসহ নানা পোশাকে প্রাধান্য পেয়েছে লাল ও সবুজ রং। আমাদের জাতীয় পতাকার রংকে তুলির আঁচড়ে নান্দনিকভাবে পোশাকের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পোশাকে বিজয়ের রং দিয়ে রাঙানো পোশাকগুলো আপনি পাবেন দেশীয় ফ্যাশন হাউস ইজি, অঞ্জন’স, বিশ্বরঙ, কে-ক্রাফট, রঙ বাংলাদেশসহ অন্যান্য হাউস। শুধু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, দায়িত্ব ও মূল্যবোধ থেকেই বিজয় দিবসের বিশেষ আয়োজন করে থাকে। লাল-সবুজ পতাকা, আমাদের বিজয়ের প্রতীক। বিজয়ের এই ডিসেম্বর মাসজুড়ে তাই

লাল-সবুজকে নিয়েই তাদের যত আয়োজন।

শীতের আগমনে এ আয়োজনে বিজয় দিবসে কিছুটা ভিন্নতা আনা হয়েছে। পোশাকগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে মোটা সুতি ও খাদি কাপড়। শাড়ি, থ্রি-পিস, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, ছেলেমেয়েদের কুর্তা, টি-শার্ট ইত্যাদিতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ

লেখা এবং লাল-সবুজ রঙের মাধ্যমে উঠে এসেছে দেশীয় ভাবনা। পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান এসেছে ডিজাইনের অনুষঙ্গ হিসেবে। কাজের মাধ্যম হিসেবে এসেছে টাইডাই, ব্লক, বাটিক, অ্যাপলিক, ক্যাটওয়াক, স্ক্রিন প্রিন্ট ইত্যাদি। আর পোশাকের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যেই।

দরদাম

সুতির শাড়ির দাম ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। পাঞ্জাবি ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা। সিঙ্গেল কামিজ ১ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া থ্রি-পিসে লাল ওড়নাকে পতাকার আদলে তৈরি করা হয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য আছে লাল ও সবুজ পোশাক। দাম ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

পোশাকের পাশাপাশি বর্তমান তরুণীরা সাজসজ্জায় অনেক এগিয়ে। সাজ পোশাকের ভেতর দিয়ে বিজয় দিবসে নিজেদের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবিকেই তুলে ধরার চেষ্টা করে তারা। এদিন বাঙালির পোশাকে উঠে আসে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রং। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট, ফতুয়ায় ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশীয় চেতনার ছোঁয়ায় নিজেদের রাঙিয়ে তোলেন তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত।

বাঙালিয়ানা মানেই তো শাড়ি। তাই শাড়িতে সেজে উঠতে চান আমাদের নারীরা। যেহেতু শীতকাল চলছে, ফ্যাশনে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকবেই। চাইলে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরতে পারেন লম্বা হাতার ব্লাউজ। অথবা যে কোনো একটি রঙের শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে নিতে সঙ্গী হতে পারে পছন্দের লাল-সবুজ শাল। যারা শাড়ি পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তারা সালোয়ার-কামিজ অথবা পছন্দের ডিজাইনের লম্বা ধরনের কুর্তা পরে নিতে পারেন। কামিজ বা কুর্তার সঙ্গেও পছন্দসই একটি শাল। শাড়ির পাশাপাশি দিবসটিতে সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়ার ফ্যাশনও কম যায় না। যারা শাড়ি পরতে চান না, তারা সালোয়ার-কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ, টপস এবং টপসের সঙ্গে লাল-সবুজ সিঙ্গেল ওড়না, ফতুয়া, জিন্স পরতে পারেন।

বাঙালি নারীর সাজ গহনা ছাড়া যেন অপূর্ণ। শাড়ির সঙ্গে লাল-সবুজ হাতভরা রেশমি কাচের চুড়ি অথবা বিভিন্ন মেটালের চুড়ি পরা যেতে পারে। গলা, কানে গহনা হিসেবে বিডস, পার্ল, মেটালের গহনা দিবসভিত্তিক সাজপোশাকে বেশ মানিয়ে যায়। মাটির গহনা, পাথরের সেট, পুঁতি, বিডস ইত্যাদি থাকে এ ধরনের গহনায়।

এবার আসা যাক মেকআপ আর চুলের সাজসজ্জায়। শাড়ির সঙ্গে ভারী সাজ ভালোই লাগবে। কুর্তি, টপসের সঙ্গে হালকা সাজই সুন্দর। এ ছাড়া খোলা চুলে ওয়েভ কার্ল, স্পাইরাল করে নিতে পারেন। যারা চুল আটকে রাখতে চান তারা চুলে বেণি করতে পারেন, পনিটেল, ফ্রেঞ্চ বেণি করে নিলেও ভালো।

সবশেষ, এ বিশেষ দিনে আমরা স্মরণ করি স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন, তা ধরে রাখা তেমনই দায়িত্বপূর্ণ। আমাদের কাজ হলো এ বিজয়ের চেতনা, ঐতিহ্যের শিকড় এবং পোশাকের শিল্পকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া। যাতে প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক পরিবার, প্রত্যেক শিশুর পরিধানে ফুটে ওঠে এ দেশের গল্প—যে গল্প বীরত্বের, ভালোবাসার এবং অদম্য প্রত্যয়ের। বিজয়ের গৌরব আমাদের পথ দেখাক, ঐতিহ্য আমাদের শিকড়কে দৃঢ় করুক এবং পোশাকের রঙে প্রতিবার নতুন করে ফুটে উঠুক বাংলার অমর সৌন্দর্য।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশি নাবিকসহ তেলবাহী জাহাজ জব্দ করল ইরান

জামায়াত নেতাদের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রদূতের বৈঠক

সরকারি খাস জমির মাটি কাটার প্রতিবাদে এলাকাবাসীর বিক্ষোভ

‘নেতা-মন্ত্রীরা মেসিকে দেখল সেই টাকা আমরা দিলাম’

এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না যারা

স্ক্যাম ও জালিয়াতি শনাক্ত করতে সাহায্য করবে অ্যান্ড্রয়েডের এই গোপন ফিচার

ট্রাম্পের ‘যুদ্ধবিরতি’ বললেও থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত চলছে

মিয়ানমারের মর্টারশেল-গুলির শব্দে কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত

নির্বাচনে ভোটার হয়েও ভোট দিতে পারবেন না যারা

জামায়াতে যোগ দিলেন সাবেক এমপি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান

১০

ব্যাট করেন ১৬৬ স্ট্রাইকরেটে, এবার আসছেন বিপিএল কাঁপাতে

১১

ইউটিউবে আসছে আকর্ষণীয় ফিচার, পাবেন যেসব সুবিধা

১২

ক্যানসার আক্রান্ত একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে রাফসানের বাবার আকুতি

১৩

হলিউডে আরও এক বিচ্ছেদ

১৪

দিল্লির বায়ু দূষণ চরমে

১৫

গুরুতর অপরাধে চার ক্রিকেটার নিষিদ্ধ

১৬

অস্ত্রসহ দুই সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার

১৭

আমরা প্রাইম টার্গেটকে খুঁজছি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার : ডিএমপি

১৮

স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ, স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন পলাতক

১৯

যে আমল করলে মারা গেলেও সওয়াব পেতে থাকবেন!

২০
X